আমার মাথায় কুলোবে না, আনমনে বলতে বলতে কাগজটা পকেটে রেখে দিল সে। শুয়ে পড়ল আবার।
জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা আসছে। কুকুর-কুণ্ডলী হয়ে গেল মুসা, গায়ের ওপর কিছু খড় টেনে দিল। ঠাণ্ডা কম লাগবে।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে। তন্দ্রা লাগল একসময়।
কিন্তু পুরোপুরি ঘুম আসার আগেই টুটে গেল আবার। বাইরে সতর্ক পায়ের শব্দ। ফিরে এল লোকটা?
দরজার বাইরে এসে থামল পদশব্দ। ঠেলা দিল পাল্লায়। খুলল না দেখে জোরে ধাক্কা দিল। সে বোধহয়, ভাবছে, কোন কিছুর সঙ্গে আটকে গেছে পাল্লা। ঠেলাঠেলিতে আঙটা থেকে খসে পড়ল লাঠি, ভেতরে ঢুকল নোকটা। আবার
ভেজিয়ে দিল দরজা।
দরজার কাছে পলকের জন্যে লোকটার চেহারা দেখেছে মুসা। না, বুলেটমাথা নয়। এর মাথায় ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর। খড়ের গাদায় শুতে আসবে না তো লোকটা?
না, এল না। একটা চটের বস্তার ওপর বসে নিজে নিজেই কথা শুরু করল। হলো কি? আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? বিড়বিড় করে আরও কিছু বলল, বুঝতে পারল না মুসা।
দূর কি হলো? বলে উঠল লোকটা। মাথার ওপর দু-হাত তুলে গা মোড়ামুড়ি করল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আবার দরজার কাছে। বাইরে উঁকি দিয়ে কি দেখল, ফিরে এসে বসল আবার আগের জায়গায়।
বিড়বিড় করছে না আর, একেবারে চুপ। হাই তুলছে।
সত্যিই দেখছে তো, অবাক হয়ে ভাবল মুসা, নাকি স্বপ্ন?
চুপ করে পড়ে রইল সে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করল এক সময়, একটা বনের ভেতর দিয়ে চলেছে। যেদিকেই তাকায়, শুধু জোড়ায় জোড়ায় গাছ। বিচিত্র ঘণ্টার শব্দ কানে বাজছে একটানা।
দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙল মুসার। সকাল হয়ে গেছে। প্রথমেই চোখ গেল বস্তাটার দিকে। কেউ নেই। গোলাঘরে খড়ের গাদার ভেতরে শরীর ডুবিয়ে রয়েছে সে একা।
৫
উঠে আড়মোড়া ভাঙল মুসা। সারা গায়ে ধুলো-মাটি, নোংরা। খিদেও পেয়েছে। আচ্ছা, পয়সা পেলে রুটি, পনির আর এক গেলাস দুধ দেবে তো বৃদ্ধা? রবিনেরও নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। কি অবস্থায় আছে কে জানে।
সাবধানে বাইরে বেরোল মুসা। চিলেকোঠার জানালার নিচে এসে দাঁড়াল। রবিনের উদ্বিগ্ন মুখ দেখা যাচ্ছে।
কেমন? হাত নেড়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভাল, হাসল রবিন। কিন্তু নিচে তো নামতে পারছি না। মহিলার ছেলে সাংঘাতিক বদমেজাজী। কয়বার যে গালাগাল করেছে বেচারী বুড়িটাকে। কানে শোনে না, এটা যেন তার দোষ।
তাহলে ও বেরিয়ে যাক, চট করে ফিরে তাকাল মুসা, কে জানি আসছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ঢুকল আবার গোলাঘরে।
বেড়ার ছিদ্র দিয়ে দেখল, বেঁটে এক লোক, চওড়া কাঁধ, সোজা হয়ে দাঁড়ালে সামান্য কুঁজো মনে হয়, মাথায় এলোমেলো চুলের বোঝ। গতরাতে দ্বিতীয় বার একেই ঢুকতে দেখেছে মুসা।
আরে, এদিকেই তো আসছে। কিন্তু না, গোলাঘরে ঢুকল না লোকটা। পাশ দিয়ে চলে গেল। গেট ভোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এল মুসার।
চলে গেছে, ভাবল মুসা। যাই এবার।
আবার বেরোল গোলাঘর থেকে।
দিনের আলোয় বড় বেশি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ছোট্ট সাদা বাড়িটাকে। নিঃসঙ্গ, নির্জন।
ঘরে ঢুকল মুসা। রান্নাঘরে পাওয়া গেল বৃদ্ধাকে। সিংকে বাসন-পেয়ালা ধুচ্ছে। মুসাকে দেখে অস্বস্তি ফুটল চোখে। ও, তুমি। ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাদের কথা।-জলদি তোমার বন্ধুকে নিয়ে চলে যাও। আমার ছেলে দেখলে
কিছু রুটি আর পনির দিতে পারবেন? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। বুঝল, লাভ হবে না। গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও শুনতে পাবে না মহিলা, একেবারেই কালা। হাত তুলে টেবিলে রাখা রুটি দেখাল সে।
না না! আঁতকে উঠল বৃদ্ধা। জলদি চলে যাও। আমার ছেলে এসে পড়বে।
ঠিক এই সময় পায়ের শব্দ হলো। মুসা কিছু করার আগেই ঘরে ঢুকল লোকটা, যাকে খানিক আগে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।
হাতের ছোট ঝুড়িতে কয়েকটা ডিম।
চোখ গরম করে তাকাল লোকটা। এই ছেলে, এখানে কি? কি চাই?
না, কিছু না…মানে, এই…আমাদের কাছে কিছু রুটি বেচবে কি না…
আমাদের? তুমি একা নও?
নিজেকে জুতোপটা করতে ইচ্ছে হলো মুসার, মুখ ফসকে আমাদের বলে ফেলেছে। কিন্তু ফেলেছে তো ফেলেছেই, কথা ফিরিয়ে নেয়া আর যাবে না। চুপ করে রইল।
কি হলো? রা নেই কেন? গর্জে উঠল লোকটা। এতক্ষণে বুঝলাম, ডিম যায় কোথায়? তোমরাই চুরি করো রোজদাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা…
আর কি দাঁড়ায় মুসা? ঝেড়ে দিল দৌড়। গেট পেরিয়ে ছুটল। দুপদুপ করছে বুক, পেছনে তাকানোর সাহস নেই। ঘর থেকেই বোধহয় বেরোয়নি।
পায়ে পায়ে আবার গেটের কাছে ফিরে এল মুসা। উঁকি দিয়ে দেখল, একটা বড় কাঠের পাত্র হাতে নিয়ে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে লোকটা, সাদা বাড়ির পেছনে। বোধহয় মুরগীর খাবার দিতে যাচ্ছে।
এই-ই সুযোগ। ঢুকে পড়ল মুসা। চিলেকোঠার জানালায় দেখা যাচ্ছে রবিনের মুখ। ইশারায় নেমে আসতে বলল তাকে মুসা।
রবিন নেমে আসতেই আর দাঁড়াল না। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। তাড়াতাড়ি পা চালাল।
আশপাশের অঞ্চল রাতে লেগেছিল এক রকম, এখন লাগছে আরেক রকম।
অনেকখানি আসার পর প্রথম কথা বলল রবিন, আরিব্বাপরে! সাংঘাতিক হারামী লোক। আর ওটা একটা ফার্ম হলো নাকি? গরু-শুয়োর কিছু নেই। একটা কুত্তাও না।
মনে হয় না ওটা ফার্ম, বেড়ার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল মুসা, ফিরে তাকাল একবার বাড়ির ভাঙা গেটের দিকে। শিওর, পথ হারিয়েছিলাম কাল রাতে। ভুল জায়গায় উঠেছি। ইয়েলো পণ্ড ফার্ম হতেই পারে না।