বাইরে বেশি হাঁটাহাঁটি করার সাহস হলো না মুসার। বৃদ্ধার ছেলের সামনে যদি পড়ে যায়? সহজেই খুঁজে পেল গোলাঘরটা। টর্চের আলো সাবধানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল।
ঘরের এক কোণে খড়ের গাদা। শোয়ার জায়গা পাওয়া গেল। ভাঙা একটা বাক্স দেখে সেটা তুলে এনে দরজার পাশে রেখে বসল। ভাঙা গেটটা দেখা যায়। কিশোর আর জিনা আসবে তো এই বৃষ্টির মাঝে? এলে কি ওই গেট দিয়েই ঢুকবে?
পেটের ভেতর ছুঁচো নাচছে। খাবার বের করে খেতে শুরু করল মুসা, একই সঙ্গে চোখ রাখল গেটের দিকে। বৃদ্ধার ছেলে এলে দেখতে পাবে।
ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। ঘন ঘন হাই তুলছে। তবু জোর করে চোখ খোলা রেখে বসে রইল।
কেউ এল না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়ালেই চোখে পড়ে বাড়ির জানালা। বৃদ্ধাকে দেখা যায়, সেলাই করছে।
দু-ঘণ্টা পেরোল। আটটা বাজে। জিনা আর কিশোরের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে মুসা।
ঝুড়িতে সেলাইয়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখল বৃদ্ধা। মুসার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, ফিরে এল না। হারিকেনটা আগের জায়গায়ই জ্বলছে, ছেলের জন্যেই জ্বেলে রেখে গেছে বোধহয় বৃদ্ধা, মুসা ভাবল।
বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। তারা ফুটেছে। ছুটে চলা মেঘের ফাঁকে উকিঝুঁকি দিচ্ছে চাঁদ। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসবে।
প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভয় অনেকখানি কেটে গেল মুসার। গোলাঘর থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে এগোল জানালার দিকে। মনে কৌতূহল। কি করছে বৃদ্ধা?
কোণের নড়বড়ে সোফাটায় শুয়ে পড়েছে মহিলা। গলা পর্যন্ত তুলে দিয়েছে কল। বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে।
আগের জায়গায় ফিরে এল মুসা। জিনা আর কিশোরের জন্যে বসে থেকে আর লাভ আছে? ভাবল সে। রাতে ওরা ফিরবে বলে মনে হয় না। রাফিয়ানকে ডাক্তার দেখিয়ে র্যাংকিন ভিলেজে ফিরে সরাইখানায় রাত কাটানোটাই স্বাভাবিক।
বৃষ্টি না হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল।
বড় করে হাই তুলল সে। যাই, শুয়ে পড়িগে, মনে মনে বলল। যদি আসেই ওরা, সাড়া পাব।
দরজা বন্ধ করল মুসা। খিল-টিল কিছু নেই। দুটো করে আঙটা লাগানো আছে ভেতরে-বাইরে। ভেতরের আঙটা দুটোয় দুটো লাঠি ঢুকিয়ে আটকে দিল সে। খিলের বিকল্প। কেন এই সাবধানতা, নিজেই জানে না। হয়তো অবচেতন মনে রেখাপাত করেছে বৃদ্ধার ছেলের বদমেজাজের কথাটা।
খড়ের গাদায় শুতে না শুতেই ঘুমে অচেতন হয়ে গেল মুসা।
বাইরে আরও পরিষ্কার হয়েছে আকাশ। বেরিয়ে এসেছে সঁদ, পূর্ণতা পায়নি এখনও, তবে যথেষ্ট বড় হয়েছে। পাথরের পুরানো বাড়িটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে ঘোলাটে জ্যোৎস্না।
ঘুমাচ্ছে মুসা। স্বপ্নে দেখছে রাফিয়ানকে, জিনা, কিশোর আর ভাঙা বাড়িটাকে, কানে আসছে যেন ঘণ্টাধ্বনি।
হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুম। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। আরি, খোঁচা লাগছে কেন? বিছানায় কাটা ছড়িয়ে দিল নাকি কেউ? তারপর মনে পড়ল, খোঁচা তো লাগবেই। শুয়ে আছে খড়ের গাদায়। কাত হয়ে শুলো, কুঁজো হয়ে।
একটা মৃদু শব্দ কানে এল। গোলাঘরের কাঠের বেড়ায় আঁচড়ের মত। উঠে বল মুসা। ইদুর?
কান পেতে আছে সে। শব্দ ঘরের ভেতর নয়, বাইরে থেকে আসছে। থেমে, একটা নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিয়ে আবার শুরু হলো। তারপর, মুসার ঠিক মাথার ওপরে ভাঙা একটা জানালায় আলতো টোকা দিল কেউ।
চুপ করে আছে মুসা। ইঁদুরে আঁচড়াতে পারে, কিন্তু টোকা দিতে পারে না। তাহলে কে? দম বন্ধ করে পড়ে রইল সে।
রবিন! রবিন? ফিসফিসিয়ে ডাকল কেউ।
সাড়া দিতে গিয়েও দিল না মুসা। গলাটা অচেনা, কিশোরের মত লাগছে না। কিন্তু রবিনের নাম জানল কি ভাবে? কেউ যে শুয়ে আছে ঘরে, এটাই বা কি করে জানল?
আবার টোকার শব্দ হলো। গলা আরেকটু চড়িয়ে ডাকল লোকটা, রবিন। রবিন?
না, কিশোর নয়। জিনা তো নয়ই।
ওঠো, বলল নোকটা। অনেক দূর যেতে হবে আমাকে। ওই মেসেজটা নিয়ে এসেছি।
জানালার কাছে যাওয়া উচিত হবে না, ভাবল মুসা। কিন্তু এ-ও চায় না, কোন সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ুক লোকটা। জানালার চৌকাঠের কাছে মাথা তুলল সে, কিন্তু মুখ বের করল না। মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে কণ্ঠস্বর বিকৃত করে ফিসফিস করে জবাব দিল, আছি, বলো।
এত ঘুম? বিরক্ত হয়ে বলল লোকটা। কখন থেকে ডাকছি। শোনো, জেরি মেসেজ দিয়েছে। টু-ট্রীজ। ব্ল্যাক ওয়াটার। ওয়াটার মেয়ার। আরও বলেছে, টিকসি নোজ। তোমাকে এটা দিতে বলেছে, টিকসির কাছে আছে আরেকটা। নাও, জানালা দিয়ে এক টুকরো কাগজ ছেড়ে দিল সে ভেতরে।
বেড়ার ছোট একটা ছিদ্র দিয়ে দেখছে মুসা। বিষণ্ণ মুখ, কুতকুতে চোখ, মাথাটা দেখতে অনেকটা বুলেটের মত।
রবিন? আবার বলল লোকটা। সব মনে রাখতে পারবে তো? টু ব্রীজ। ব্ল্যাক ওয়াটার। ওয়াটার মেয়ার। টিকসি নোজ।…যাই তাহলে।
চলে গেল লোকটা।
কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে ভাবছে মুসা। কে লোকটা? রবিনের নাম জানল কিভাবে? আর তাকেই বা রবিন মনে করার কারণ কি? রবিনের নাম যখন জানে, তার নাম কি জানে না? রাত দুপুরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কি এক
অদ্ভুত মেসেজ দিয়ে গেল, মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যায় না।
ঘুম আর আসবে না সহজে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মুসা। কিচ্ছু নেই, শুধু রহস্যময় বাড়িটার নির্জনতা, আর খোলা আকাশ।
খড়ের গাদায় বসে পড়ল সে। টর্চ জ্বেলে দেখল কাগজের টুকরোটা। ময়লা, এক পাতার ছেড়া অর্ধেক। পেনসিলে কিছু আঁকিবুকি রয়েছে, যার কোনই মানে বোঝা যায় না। কিছু শব্দ রয়েছে এখানে ওখানে, যেগুলো আরও দুর্বোধ্য।