রবিনের কথার মানে বুঝে ফেলেছে। কি বলতে চাইছ?
বুঝেছ তুমিও। এখন পুরানো আমল নয়, তাহলে অন্ধকারে ঝড়-বৃষ্টির মাঝে ওই ঘণ্টা…
চুপ চুপ ! আর বোলো না, ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল মুসা। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না। টর্চের রশ্মির সামনে শুধু অগুনতি বৃষ্টির ফোঁটা।
যেমন শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল শব্দ।
এরপরও কান পেতে রইল দুজনে। কিন্তু আর শোনা গেল না।
চলো, হাঁটি, বলল মুসা। ফার্মটা খুঁজে বের করা দরকার। আবার কখন শুরু হয়ে যায়…
বেড়ার ধার ধরে আবার এগিয়ে চলল ওরা।
কতক্ষণ পর বলতে পারবে না, আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ওই যে।
মুসাও দেখল। আলো। না, বীকন নয়, জ্বলছে-নিভছে না। একভাবে জ্বলছে টিমটিম করে।
পাওয়া গেল বাড়িটা, জোরে নিঃ বাস ফেলল মুসা।
কাঠের বেড়া শেষ। একটা পাথরের দেয়ালের কাছে চলে এল ওরা। ওটার পাশ দিয়ে এল ভাঙাচোরা একটা গেটের কাছে।
ভেতরে পা রেখেই লাফিয়ে সরে এল রবিন।
কি হলো? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আলো ফেলো তো। ডোবায় না পড়ি।
দেখা গেল, ডোবায়,পা ডোবেনি রবিনের, বৃষ্টির পানি জমেছে ছোট একটা গর্তে। গর্তটার পাশ কাটিয়ে এল দুজনে।
কাদা প্যাঁচপ্যাঁচ করছে সরু পথে। পথের শেষ মাথায় বাড়ির সাদা দেয়াল, ছোট একটা দরজা। পেছনের দরজা হবে, ভাবল মুসা। পাশের জানালা দিয়ে আলো আসছে।
জানালার কাছে এসে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। মাথা নিচু করে সেলাই করছে এক বৃদ্ধা।
দরজার পাশে ঘণ্টার দড়ি-টুড়ি কিছু দেখতে পেল না মুসা। জোরে ধাক্কা দিল। সাড়া নেই। বন্ধ রইল দরজা। উঁকি দিল আবার জানালা দিয়ে। তেমনি ভাবে সেলাই করছে মহিলা, নড়েওনি।
কানে শোনে না নাকি? বলতে বলতেই দরজায় কিল মারল মুসা। সাড়া মিলল না এবারও। খবরই নেই যেন মহিলার।
এভাবে কিলাকিলি করে কিছু হবে না, দরজার নব ধরে মোচড় দিল মুসা।
ঘুরে গেল নব। ঠেলা দিতেই পাল্লাও খুলল।
পা মোছার জন্যে হেঁড়া একটা মাদুর বিছানো রয়েছে পাল্লার ওপাশে। তারপরে সরু প্যাসেজ। প্যাসেজের মাথায় পাথরের সিঁড়ি। সদর দরজার কাছেই ডানে আরেকটা দরজা, পান্না সামান্য ফাঁক। হারিকেনের স্নান আলো আসছে।
ঠেলে পাল্লা পুরো খুলে ভেতরে পা রাখল মুসা। তার পেছনে রবিন।
তবু তাকাল না মহিলা। সেলাই করেই চলেছে।
একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়াল মুসা।
এইবার দেখতে পেল বৃদ্ধা। চমকে এত জোরে লাফিয়ে উঠল, ঠেলা লেগে উল্টে পড়ে গেল তার চেয়ার।
সরি, এভাবে চমকে যাবে বৃদ্ধা, ভাবেনি মুসা। দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলাম। শোনেননি।
বুকে হাত চেপে ধরে আছে মহিলা। ইস্, কি ভয়ই না দেখালে!…কে তোমরা? এই অন্ধকারে কোত্থেকে?
চেয়ারটা তুলে আবার জায়গামত সোজা করে রাখল মুসা। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। এটা কি ইয়েলো পণ্ড ফার্ম? এর খোজেই এসেছি আমরা। রাতটা কাটানো যাবে? আরও দুজন আসছে।
তর্জনীর মাথা দিয়ে বার দুই কানে টোকা দিল মহিলা, মাথা নাড়ল। শুনি না। ইশারায় বলো। পথ হারিয়েছ?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
এখানে তো থাকতে পারবে না, আমার ছেলে পছন্দ করে না এসব। ও এল বলে। সাংঘাতিক বদরাগী। চলে যাও।
মাথা নাড়ল মুসা। জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টিভেজা রাত দেখল। তার আর
রবিনের ভেজা জুতো আর কাপড় দেখাল।
হুঁ, পথ হারিয়েছ তোমরা। ভিজেছ। ক্লান্ত। যেতে চাও না, এই তো? আমার ছেলেকে নিয়ে যে বিপদ। অচেনা কাউকে সহ্য করতে পারে না।
রবিনকে দেখাল মুসা, তারপর হাত তুলে কোণের একটা সোফা দেখাল। নিজের বুকে হাত রেখে সরিয়ে এনে নির্দেশ করল দরজার দিকে।
বুঝল মহিলা। তোমার বন্ধু সোফায় থাকবে বলছ। তুমি বাইরে কোন ছাউনি কিংবা গোলাঘরে কাটিয়ে দিতে পারবে।
আবার মাথা ঝাঁকাল মুসা।
কিন্তু সেই একই ব্যাপার, আমার ছেলে পছন্দ করে না… রবিন আর মুসার ভেজা মুখের দিকে চেয়ে অবশেষে বোধহয় করুণা হলো মহিলার। হতাশ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে এগোল একটা দেয়াল-আলমারির দিকে।
দরজা খুলল। আলমারি মনে করেছে দুই গোয়েন্দা, আসলে ওটা ঘরের আরেকটা দরজা। ওপাশ থেকে খুব সরু কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে।
রবিনকে বলল মহিলা, তুমি ওপরে চলে যাও। কাল সকালে আমি না ডাকলে আর নামবে না। আহ, যাও দেরি কোরো না।
মুসার দিকে চেয়ে দ্বিধা করছে রবিন। তুমি?
তুমি যাও তো, রবিনের হাত ধরে ঠেলে দিল মুসা। আমি গোলাঘরে গিয়ে থাকি। গিয়ে দেখো জানালা-টানালা আছে কিনা। রাতে বেকায়দা দেখলে ডেকো। নিচেই থাকতে হবে আমাকে।
ঠিক আছে, গলা কাঁপছে রবিনের, অনিচ্ছাসত্ত্বেও পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।
নোংরা পুরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল খুদে একটা চিলেকোঠায়। একটা মাদুর আছে, পরিষ্কারই, আর একটা চেয়ার। একটা কম্বল ভঁজ করা রয়েছে চেয়ারের হেলানে, বসার জায়গায় এক জগ পানি।
ছোট জানালাও আছে একটা। ওটা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ডাকল রবিন, মুসা? মুসা?
হ্যাঁ, শুনছি, নিচ থেকে সাড়া দিল মুসা। চুপচাপ শুয়ে থাকো। অসুবিধে না হলে আর ডেকো না।
৪
সঙ্গে খাবার যা আছে খেয়ে নিল রবিন। ঢকঢক করে আধ জগ পানি খেয়ে মাদুরের ওপর কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। জিনা আর কিশোরের সাড়ার আশায় কান খাড়া। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখতে পারল না। সারা দিন অনেক পরিশ্রম গেছে। ঘুমিয়ে পড়ল সে।