জিনা আর কিশোর পাহাড়ের দিকে রওনা হলো। পাশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে রাফিয়ান।
সেদিকে চেয়ে আনমনে বলল মুসা, ভাল হয়ে গেলেই বাঁচি। নইলে ছুটিটাই মাটি হবে।
ঘুরে আরেক দিকে রওনা হলো সে আর রবিন।
নির্জন পথ।
এক জায়গায় একটা লোকের সঙ্গে দেখা হলো। টমটম চালিয়ে আসছে। বিষণ্ণ চেহারা, মাথাটা অনেকটা বুলেটের মত।
ডাকল মুসা।
ঘোড়ার রাশ টেনে থামাল লোকটা।
এ-রাস্তা কি ইয়েলো পণ্ডে গেছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
আ, মাথা নুইয়ে বলল লোকটা।
সোজা? নাকি ডানে বাঁয়ে আর কোন গলি আছে?
আ, আবার মাথা নোয়াল লোকটা।
এটাই পথ তো? মানে ওদিকে যেতে হবে? গলা চড়িয়ে হাত নেড়ে দেখাল মুসা।
আ, বলে চাবুক তুলে পেছন দিক দেখাল লোকটা, তারপর পশ্চিমে দেখাল।
ডানে ঘুরতে হবে?
আ, মাথা নোয়াল লোকটা। হঠাৎ খোঁচা মারল ঘোড়ার পেটে। লাফিয়ে সামনে বাড়ল ঘোড়া, আরেকটু হলেই দিয়েছিল মুসার পা মাড়িয়ে।
খালি তো আ আ করল, মুসার মতই রবিনও অবাক হয়েছে লোকটার অদ্ভুত ব্যবহারে। কি বোঝাল সে-ই জানে।
৩
হঠাৎ করেই নামল রাত। সূর্য ডোবার পর অন্ধকার আর সময়ই দেয়নি সাঁঝকে। কাল মেঘ জমেছে আকাশে।
এ কি কাণ্ড দেখো, গম্ভীর হয়ে বলল মুসা। দিনটা কি ভাল গেল। বোঝাই যায়নি বৃষ্টি আসবে।
তাড়াতাড়ি চলো, বলল রবিন। ভিজে চুপচুপে হয়ে যাব। মাথা বাঁচানোরও জায়গা নেই।
মোড় নিয়ে কয়েক কদম এগিয়েই থমকে গেল দুজনে। খুব সরু পথ, পাতাবাহারের ঝোপের সুড়ঙ্গ। সকালে এমন একটা পথে হেঁটে এসেছে। দিনের বেলায়ই আবছা অন্ধকার ছিল ওটাতে। এটাতে এখন গাঢ় অন্ধকার।
ঠিক পথেই যাচ্ছি তো? মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।
কি জানি। রবিনও বুঝতে পারছে না।
যা থাকে কপালে, ভেবে রবিনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল মুসা। কয়বার মোড় নিয়েছে পথ, কতখানি এঁকেবেঁকে গেছে, কিছুই বোঝা গেল না। অন্ধের মত এগিয়ে চলেছে দুজনে। জুতোর তলায় ছপছপ করছে কাদা-পানি।
নর্দমায় নামলাম না তো? মুসা বলল। জুতোর ভেতর পানি ঢুকছে।
আমারও সুবিধে লাগছে না, মুসা। যতই এগোচ্ছি, পানি কিন্তু বাড়ছে। শেষে গিয়ে কুয়া-টুয়ায় না পড়ে মরি।
টর্চটা কোথায় রাখলাম? ব্যাগের ভেতরে খুঁজছে মুসা। ফেলে এলাম, না কি? রবিন, তোমারটা বের করো তো।
টর্চ বের করে দিল রবিন।
জ্বালল মুসা। আলোর চারপাশ ঘিরে যেন আরও ঘন হলো অন্ধকার। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল সে। সামনে একটু দূরে, এক জায়গায় কাঠের বেড়া শুরু হয়েছে রাস্তার এক পাশ থেকে, ওখানে খানিকটা জায়গায় পাতাবাহার নেই, কেটে সাফ করা হয়েছে বোধহয়। পথটা সরু খালের মত, দু-ধারে উঁচু পাড়।
বেড়াটা নিশ্চয় কোন ফার্মে গিয়ে শেষ হয়েছে, বলল মুসা। আস্তাবল কিংবা গরুর খোঁয়াড় পেলেও মাথা বাঁচাতে পারি, ভিজতে হবে না। চলো, দেখি।
পাড়ে উঠে বেড়া ধরে ধরে এগোল ওরা। ফসলের খেতের মাঝখান দিয়ে সরু পথ।
মনে হচ্ছে এটা শর্টকাট, আন্দাজ করল মুসা। ফার্ম হাউসটা বোধহয় আর বেশি দূরে না।
একটা দুটো করে ফোঁটা পড়তে শুরু করল, যে কোন মুহূর্তে ঝুপঝুপ করে নামবে বৃষ্টি।
মুসার কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না রবিন। সত্যিই পাবে তো ফার্মটা?
জোরে নামল বৃষ্টি। বর্ষাতি বের করা দরকার। দ্রুত এদিক ওদিক তাকাল ওরা। কোথায় ঢুকে বের করা যায়? ব্যাগের মধ্যে পানি ঢুকলে সব ভিজে যাবে, দুর্ভোগ পোহাতে হবে তখন।
মাঠের মধ্যেই দুটো আলের মিলনস্থলে ঘন একটা পাতাবাহারের ঝোপ চোখে পড়ল। দৌড়ে এসে তার ভেতরে ঢুকল দুজনে। ব্যাগ খুলে বর্ষাতি বের করল।
বৃষ্টি নামায় আরও ঘন হলো অন্ধকার। টর্চের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না।
আলো তো দেখছি না, বলল রবিন। কই ফার্মটা?
কি জানি। বুঝতে পারছি না। ফিরে গিয়ে আবার সুড়ঙ্গে নামব? নাহ, তা-ও বোধহয় ঠিক হবে না।
পথ যখন রয়েছে, নিশ্চয় কোথাও গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু কোথায়?
না বুঝে আর এগোনোর কোন মানে হয় না। দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে ভাবছে। ওরা, কোন দিকে যাবে? কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল রবিন।
হঠাৎ করে এমনভাবে শুরু হলো শব্দটা, চমকে উঠল দুজনে। একে অন্যের হাত চেপে ধরল। নির্জন মাঠে, অন্ধকার রাতে এই দুর্যোগের মাঝে অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
ঘণ্টার শব্দ।
বেজেই চলেছে। প্রলয়ের সঙ্কেত যেন। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল দুই কিশোরের।
কোথায় বাজছে? এভাবে? ফিসফিস করল রবিন, জোরে বলার সাহস নেই।
কোথায় বাজছে মুসা জানবে কি করে? সে-ও রবিনের মতই চমকে গেছে। কাছাকাছি নয়, দূরে কোথাও বাজছে। কখনও জোরে, কখনও আস্তে। এলোমেলো বাতাস বইছে, একবার এদিক থেকে, একবার ওদিক। বাতাস সরে গেলে শব্দও কমে যাচ্ছে, যে-ই বাড়ছে, অমনি যেন তাদেরকে ঘিরে ধরছে বিচিত্র ঘণ্টা-ধ্বনি।
ইস, থামে না কেন? দুরুদুরু করছে মুসার বুক। গির্জার ঘণ্টা নয়।
না, তা-তো নয়ই, কেঁপে উঠল রবিনের গলা। কোন ধরনের সঙ্কেত হতে পারে…আমি শিওর না। অস্বস্তিতে হাত নাড়ল সে। বিড়বিড় করল, যুদ্ধ?.. বীকন কই?
কি বিড়বিড় করছ?
অ্যাঁ?…বীকন। পুরানো আমলে যুদ্ধ লাগলে ওভাবে ঘণ্টা বাজিয়ে হুঁশিয়ার করা হত গাঁয়ের লোককে। সেই সঙ্গে আলোর সঙ্কেত-বীকন বলা হত।
এখন তো পুরানো আমল নয়… চমকে থেমে গেল মুসা।