কাবাব চিবাতে চিবাতে আস্তে মাথা নাড়ল রাফিয়ান, গোঁ করে উঠল। ব্যথায়,
কেন, সে-ই জানে। কিন্তু এটাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে মুসা হাসল, কি, বলেছি না ভাল?
সবার চেয়ে অনেক বেশিই খেলো রাফিয়ান, তবে চুপচাপ রয়েছে। এই ব্যাপারটাই ভাল লাগছে না জিনার।
একেক জনের ভাগে তিনটে করে স্যাণ্ডউইচ বাঁচল। আর অর্ধেক টুকরো করে কেক। বাকি সব সাবাড় করে ফেলেছে।
ডিকের চেয়ে কম কি আমরা? ভুরু নাচাল মুসা। ও ছ-টা খায়, আমরা পাঁচটা…
তুমি সাতটা খেয়েছ, শুধরে দিল রবিন। নিজেদেরগুলো সেরেও আমাদের ভাগ থেকে মেরেছ তুমি আর রাফি…
ঘউ, করে স্বীকার করল যেন রাফিয়ান। কেকের টুকরোর দিকে চেয়ে লেজ নাড়ছে। জিভে লালা। তাকে কেক দেয়া হয়নি।
বলেছিলাম না, খেলেই ভাল হয়ে যাবে রাক্ষসটা, হেসে বলল মুসা। নে খা, তুই আমার কাছ থেকেই নে… খানিকটা কেক ভেঙে কুকুরটার মুখের কাছে ফেলল।
এক চিবান দিয়েই কোত করে গিলে ফেলল রাফিয়ান। করুণ চোখে তাকাল মুসার হাতের বাকি কেকটুকুর দিকে।
তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিল মুসা। না বাবা, আর দিচ্ছি না। রাতে খেতে হবে আমার। তুমি বাপু যত পাও ততই চাও…
হাসল সবাই। কেটে গেল নিরানন্দ ভাবটা।
চলো, ওঠা যাক, বলল কিশোর। পাঁচটার আগেই ফার্মটায় পৌঁছতে হবে। এখানে আবার তাড়াতাড়ি রাত নামে।
কোন ফার্ম? জানতে চাইল রবিন।
হলুদ দীঘি।
যদি থাকার জায়গা না থাকে?
জিনাকে একটা ঘর দিতে পারলেই হলো। আমরা গোলাঘরে খড়ের গাদায়ই ঘুমোতে পারব।
কেন, আমি পারব না কেন? গলা লম্বা করে ঝাঁকি দিল জিনা।
কারণ, তুমি মেয়ে। ছেলের পোশাক পরে আছে বটে, কিন্তু মেয়ে তো।
দেখো, মেয়ে মেয়ে করবে না। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কম কিসে?
তাহলে ছেলে সেজে থাকো কেন? ফস করে বলে বসল মুসা।
থাকি, থাকি, আমার খুশি,রেগে উঠল জিনা। তোমার কি?
এই তো রেগে গেল, বিরক্ত হয়ে উঠল কিশোর। তোমাদের জ্বালায় বাপু শান্তিতে পরামর্শ করারও জো নেই। জিনা, খামাকো জেদ করছ। তুমি মেয়ে, কিছু অসুবিধে তোমার আছে, ছেলেদের যা নেই। এটা কি অস্বীকার করতে পারবে?
চুপ করে রইল জিনা। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে আর তর্ক করল না। আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল।
মালপত্রের বোঝা পিঠে তুলে নিয়ে আবার রওনা হলো ওরা। রাফিয়ান শান্ত। লাফঝাপ সব যেন ভুলে গেছে, জোরে হাঁটার চেষ্টাও করছে না। পা ফেলছে অতি সাবধানে, মেপে মেপে।
ব্যাপারটা জিনার চোখ এড়াল না। কি হয়েছে রাফি? খারাপ লাগছে?
জবাবে শুধু কাঁউ করল কুকুটা।
আরও খানিক দূর যাওয়ার পর খোড়াতে শুরু করল রাফিয়ান। পেছনের বাঁ পা ঠিকমত ফেলতে পারছে না।
থামল সবাই।
বসে পড়ে পা-টা ভালমত দেখল জিনা। মনে হয় মচকেছে, রাফিয়ানের পিঠে হাত বোলাল সে।
মৃদু গাউক করে উঠল রাফিয়ান।
যেখানে হাত লাগলে ব্যথা পায় কুকুরটা, সে জায়গার নোম সরিয়ে দেখল জিনা। আরে, যখম! রঞ্জু জমেছে, ফুলেছেও। ওইটানাটানির সময়ই লেগেছিল।
দেখি তো, বসে পড়ে কিশোরও দেখল। না, বেশি না। সামান্য। রাতে ঘুমোলেই সেরে যাবে।
কিন্তু শিওর হওয়া দরকার, খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে জিনাকে। কিশোর, গ্রাম আর কদ্দূর?
এই সামনেই। র্যাংকিন ভিলেজ। গায়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, পশু ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে।
জলদি চলো। ইস, কেন যে এত বড় হলো কুকুরটা, নইলে কোলে করেই নিতে পারতাম। হাঁটতেই পারছে না বেচারা।
যা পারে হাঁটুক এখন, বলল মুসা। একেবারে না পারলে তো বয়ে নিতেই হবে। সে তখন দেখা যাবে।
খুব আস্তে আস্তে হাঁটছে রাফিয়ান। বেশি খোড়াচ্ছে। শেষে আর পা-ই ফেলতে পারল না। মচকানো পা-টা তুলে তিন পায়ে লাফিয়ে এগোল।
ইস, কি কষ্ট বেচারারকেঁদে ফেলবে যেন জিনা।
র্যাংকিন ভিলেজে এসে ঢুকল বিষণ্ণ দলটা। গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে একটা সরাইখানা, নাম র্যাংকিন রেস্ট।
ঝাড়ন দিয়ে জানালার কাচের ধুলো ঝাড়ছে এক মহিলা।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ম্যাডাম। কাছাকাছি পশু ডাক্তার কোথায় আছে?
রাফিয়ানের দিকে তাকাল মহিলা। কাছাকাছি বলতে তো ছ-মাইল দূরে, ডারবিনে।
শুকিয়ে, এতটুকু হয়ে গেল জিনার মুখ। ছয় মাইল! কিছুঁতেই হেঁটে যেতে পারবে না রাফিয়ান।
বাস-টাস কিছু আছে? জিজ্ঞেস করল জিনা।
না, বলল মহিলা। তবে মিস্টার নরিসকে বলে দেখতে পারো। তার ঘোড়ার গাড়ি আছে। কুকুরটার পা বেশি খারাপ?
হ্যাঁ। ম্যাডাম, তার বাড়ি কত দূর?
এই আধ মাইল। ওই যে পাহাড়টা, ওখান থেকে ডানে চাইলেই বাড়িটা দেখতে পাবে। বড় বাড়ি। দেখলেই চিনবে। চারপাশে আস্তাবল, ঘোড়া পালে মিস্টার নরিস। খুব ভাল মানুষ। যদি বাড়িতে না পাও, বোসসা কিছুক্ষণ। রাতে বাইরে থাকে না, যেখানেই যাক ফিরে আসবে।
দ্রুত পরামর্শ করে নিল চারজনে। কিশোর বলল, মিস্টার নরিসের কাছেই যেতে হবে বোঝা যাচ্ছে। তবে সবার যাওয়ার দরকার নেই। মুসা, রবিনকে নিয়ে তুমি হলুদ দীঘিতে চলে যাও। রাতে থাকার ব্যবস্থা করে রাখখাগে। আমি জিনার সঙ্গে যাচ্ছি। ফিরতে কত রাত হয় কে জানে।
ঠিক আছে, বলল মুসা। টর্চ আছে তো তোমার কাছে? গাঁয়ে তো রাস্তায় বাতি নেই, রাতে খুব অন্ধকার হবে।
আছে, জানাল কিশোর।
চলো, কিশোর, তাড়া দিল জিনা। রবিন আর মুসার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে বলল, রাতে দেখা হবে।