কিন্তু কে শোনে কার কথা? রাফিয়ানের কানেই ঢুকল না যেন ডাক, তার এক চিন্তা, খরগোশ ধরবে।
এত বোকা নয় খরগোশেরা যে চুপচাপ বসে থেকে কুকুরের খপ্পরে পড়বে। সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল গর্তে। ভোজবাজির মত, এই ছিল এই নেই।
অনেক চেষ্টা করেও একটা খরগোশ ধরতে পারল না রাফিয়ান। তার কাণ্ড দেখে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল মুসা আর জিনা।
অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল ব্যর্থ রাফিয়ান, জিভ আধহাত বেরিয়ে পড়েছে।
ভুল নাম রেখেছে, বলল রবিন। নাম রাখা উচিত ছিল আসলে খরগোশ পাহাড়। চলো, উঠি।
চূড়া পেরিয়ে পাহাড়ের উল্টোদিকের ঢাল ধরে নামতে শুরু করল ওরা। এদিকে খরগোশ যেন আরও বেশি। রাফিয়ান বোধহয় ভাবল, অন্যপাশের চেয়ে এপাশের ওরা বোকা, তাই আবার তাড়া করল।
সেই একই কাণ্ড। সুড়ুৎ।
রেগে গেল রাফিয়ান। গর্তে ঢোকা? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। বড় একটা খরগোশকে বাইরে দেখে তাড়া করল। খরগোশটাও সেয়ানা। এঁকেবেঁকে এপাশে ওপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল বড় একটা গর্তের ভেতর।
কোন রকম ভাবনাচিন্তা না করেই মাথা ঢুকিয়ে দিল রাফিয়ান, ঢুকে গেল গর্তে। তারপরই পড়ল বিপদে। আটকে গেল শরীর। না পারছে ঢুকতে, না বেরোতে। অসহায় ভাবে পেছনের পা ছুঁড়তে লাগল শুধু।
আরে! দৌড় দিল জিনা। এই রাফি, রাফি, বেরিয়ে আয়। আয় জলদি।
বেরোতে পারলে তো বাঁচে এখন রাফিয়ান, জিনার ডাকের কি আর অপেক্ষা করে? কিন্তু পারছে তো না। পেছনের পায়ের নখ দিয়ে আঁচড়ে ধুলোর ঝড় তুলেছে, বেরোনোর চেষ্টায়।
পুরো বিশ মিনিট লাগল রাফিয়ানকে বের করে আনতে। প্রথমেই গর্তে ঢোকার চেষ্টা করল মুসা। তার বিরাট শরীর ঢুকল না। কিশোর আর জিনাও ঢুকতে পারল না। রোগা-পটকা ক্ষীণ দেহ একমাত্র রবিনের, তাকেই মাথা ঢোকাতে হলো অবশেষে।
রাফিয়ানের পেছনের পা ধরে টানতে লাগল রবিন, তার অর্ধেক শরীর গুহার বাইরে, অর্ধেক ভেতরে। কুকুরটার কাঁধের পেছন দিক আটকে গেছে একটা মোটা শেকড়ে, টেনেও বের করা যাচ্ছে না। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল।
আহ, এত জোরে টেনো না, চেঁচিয়ে উঠল জিনা। ব্যথা পাচ্ছে তো।
জোরে টেনেও তো বের করতে পারছি না, গর্তের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিল রবিন। জোর পাচ্ছি না। আমার পা ধরে টানো।
অনেক টানা-হেঁচড়ার পর বের করা গেল অবশেষে। বিধ্বস্ত চেহারা, কুঁইকুই করে গিয়ে জিনার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল রাফিয়ান। খুব ভয় পেয়েছে বেচারা।
সাংঘাতিক ব্যথা পেয়েছে কোথাও, কুকুরটার সারা গা টিপেটুপে দেখতে শুরু করল জিনা। চারটে পা-ই টেনে টেনে দেখল। ভাঙেনি। জখমও দেখা যাচ্ছে না। ব্যথা পেয়েছেই। নইলে এমন কো কো করত না। কিন্তু লাগল কোথায়?
ভয়ে অমন করছে, কিশোর বলল। জখম থাকলে তো দেখতামই। পা-ও ভাঙেনি।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারল না জিনা। পশু ডাক্তারকে দেখালে হয় না?
এখানে পশু ডাক্তার পাবে কোথায়? খামোকা ভাবছ। রাফিয়ান ঠিকই আছে। চলো, হাঁটি।
ঘুঘুমারিও পেরিয়ে এল ওরা। আলাপ-আলোচনা আর হাসিঠাট্টা তেমন জমছে। গুম হয়ে আছে জিনা। বার বার তাকাচ্ছে পাশে রাফিয়ানের দিকে। কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে।
ব্যথা পেয়েছে, এমন কোন ভাব দেখাচ্ছে না রাফিয়ান, ঠিকমতই হাঁটছে, মাঝে মাঝে গুঙিয়ে উঠছে শুধু।
এখানেই লাঞ্চ সারা যাক, কি বলো? আরেকটা পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ, তা যায়, মাথা কাত করল মুসা। নাম কি এটার?
ম্যাপে কোন নাম নেই। তবে আমি রাখতে পারি..ঢালু পাহাড়? খুব মানাবে। দেখেছ, কেমন ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক দূর… স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে কিশোরের অপূর্ব সুন্দর দুই চোখ।
ভাল লাগার মতই দৃশ্য। মাইলের পর মাইল একটানা ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল নিঃসঙ্গ প্রান্তর, ঘন সবুজ ঘাস চকচক করছে রোদে। তাতে চরছে লাজুক হরিণ আর উদ্দাম ছোট ছোট বুনো ঘোড়া। যেন পটে আঁকা ছবি।
বসে পড়ল ওরা ঘাসের গুচ্ছের নরম কার্পেটে।
অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি, দিগন্তের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল কিশোর, মন চলে গেছে তার হাজার হাজার মাইল দূরের আরেক স্বপ্নরাজ্যে, তার স্বপ্নের বাংলাদেশে। সেই দেশটাও কি এত সুন্দর, ভাবল সে, কবিতা পড়ে তো মনে হয় এর চেয়েও সুন্দর।
দেশটা সত্যি ভারি সুন্দর, কিশোরের মতই দূরে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। এই সবুজ একদিন ঢেকে যাবে ধবধবে সাদা বরফে, তুষার ঝরবে পেঁজা তুলোর মত, আকাশের মুখ অন্ধকার, মেরু থেকে ধেয়ে আসবে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা…
ওদিকে স্যাণ্ডউইচগুলো তো কাঁদতে শুরু করেছে, খাচ্ছি না বলে, বেরসিকের মত বাধা দিল মুসা। কাব্যচর্চা রেখে আগে পেটচৰ্চা সেরে নাও। আরে এই জিনা, এত গভীর হয়ে আছো কেন? তোমার মুখ কালো দেখলে তো আমার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে…
অন্য সময় হলে কথার-করাত চালাত জিনা, এখন শুধু মাথা নাড়ল। রাফি…
দূর, তুমি খামোকা ভাবছ। কিচ্ছু হয়নি। দেখো, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। পেটে বোধহয় খিদে দেখছ না আমার কেমন খারাপ লাগছে? ওরও বোধহয় তেমনি…
মুসার কথায় হেসে ফেলল জিনা। অন্যদের মুখেও হাসি ফুটল।
হুঁ, সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মুসা, দারুণ হয়েছে। ডিকের মায়ের হাতে যাদু আছে। নে, রাফি, এই কাবাবটা চেখে দেখ।