এত সুন্দর রা খুব কমই দেখেছি, তীরের নীরব গাছপালার দিকে চেয়ে আছে রবিন। এত শান্তি। এত নীরব।
তাকে ব্যঙ্গ করার জন্যেই যেন কর্কশ চিৎকার করে উঠল একটা পেঁচা। চমকে গেল রবিন।
যাও, গেল তোমার নীরবতা, হাসতে হাসতে বলল মুসা।
রবিন ঠিকই বলেছে, কিশোর বলল, এত সুন্দর রাত আমিও কম দেখেছি। ইয়ার্ডে কাজ না থাকলে, এমনি জ্যোৎস্না রাতে ছাতে উঠে বসে থাকে রাশেদচাচা, অনেকদিন দেখেছি। আকাশের দিকে, চাদের দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন ভাবে। জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন। বিশ্বাস করবে? কেঁদে ফেলেছিল চাচা, দেশের কথা, তার ছেলেবেলার কথা বলতে বলতে। বাংলাদেশে নাকি এর চেয়েও সুন্দর চাঁদ ওঠে। ফসল কাটা শেষ হলে ধু-ধু করে নাকি ফসলের মাঠ, ধবধবে সাদা। শিশির ঝরে। চাঁদনি রাতে শেয়ালের মেলা বসে সেই মাঠে, বৈঠক বসে, চাচা নাকি দেখেছে। চাচা প্রায়ই বলে, কোনমতে ইয়ার্ডের ভারটা আমার কাধে গছাতে পারলেই চাচীকে নিয়ে দেশে চলে যাবে…
আরে, এই রাফি, আমার কান খেয়ে ফেলবি নাবি? বেরসিকের মত মুসার গান তখন থামিয়ে দিয়েছিল কিশোর, সেই শোধটা নিল যেন এখন।
ওই যে, বাক্সটা না? হাত তুলে বলল জিনা।
হ্যাঁ, বাক্সটাই মারকার। চাদের আলো চিকচিক করছে ওটার ভেজা পিঠে।
কাছে এসে ভেলা থামাল।
কাপড় খুলতে শুরু করল মুসা। জিনা সাঁতারের পোশাক পরে এসেছে।
রিঙের মত করে পেঁচানো দড়ির বাণ্ডিলের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে। জিনা নামল তার পর পরই।
দম কেউ কারও চেয়ে কম রাখতে পারে না।
প্রথমে ভাসল জিনার মাথা।
তার কিছুক্ষণ পর মুসার। দম নিয়ে বলল, বাঁধন কেটে দিয়েছি পোটলাটার। আবার যেতে হবে, দড়ি বাঁধব।
জিনাকে নিয়ে আবার ডুব দিল মুসা।
দুজনে মিলে শক্ত করে ব্যাগের মুখে পেঁচিয়ে বাঁধল দড়ি। হ্যাঁচকা টান দিয়ে দেখল মুসা, খোলে কিনা। খুলল না। ওপর থেকে টেনে তোলা যাবে, বাঁধন খুলে পড়ে যাবে না ব্যাগে।
দড়ির আরেক মাথা হাতে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল মুসা। পাশে জিনা।
হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা ঝাঁকাল দুজনে।
দম নিয়ে ভেলায় উঠে এল জিনা আর মুসা।
তোয়ালেটা কোথায়? কাঁপতে কাঁপতে বলল জিনা। ইস, পানি তো না, বরফ।
তাদের দিকে নজর নেই এখন রবিন আর কিশোরের। দড়ি ধরে টেনে ব্যাগটা তুলতে শুরু করেছে। ভারের জন্যে একপাশে কাত হয়ে গেছে ভেলা। আরেকটু টান পড়লেই পানি উঠবে।
উল্টোধারে সরে গেল জিনা আর মুসা, রাফিয়ানকেও টেনে সরাল নিজেদের দিকে। সোজা হলো আবার ভেলা।
তীরের দিকে চেয়ে হঠাৎ ঘাউ ঘাউ করে উঠল রাফিয়ান।
তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ধমক দিল জিনা, চুপ! চুপ! শঙ্কিত চোখে তাকাল কুকুরটা যেদিকে চেয়ে আছে সেদিকে। টিকসিরা আসছে না তো?
কাউকে দেখা গেল না। বোধহয় শেয়াল-টেয়াল দেখেছে রাফিয়ান।
ব্যাগটা তুলে আনা হয়েছে।
আর এখানে থাকার কোন মানে নেই। তীরের দিকে রওনা হলো ওরা।
ভালয় ভালয় আস্তানায় ফিরে যেতে পারলেই বাঁচে এখন।
ভেলা আগের মতই লুকিয়ে রাখা হলো। বোটহাউসে রাখলে আর ডারটি দেখে ফেললে সন্দেহ করবে। কি ঘটেছে বুঝেও যেতে পারে।
খাড়া পাড়, শেকড় বেয়ে উঠতেই কষ্ট হয়। ভারি একটা বোঝা নিয়ে ওঠা যাবে না। ব্যাগটা নিচে রেখে, দড়িটা দাঁতে কামড়ে ধরে আগে উঠে গেল মুসা। তার পেছনে রবিন আর জিনা। কিশোর নিচে রয়েছে। দড়ি ধরে ব্যাগটা টেনে তুলতে বলল ওদেরকে।
ব্যাগটা উঠে যেতেই সে-ও উঠে এল ওপরে।
চুপ করে আছে রাফিয়ান। তারমানে ঝোপের ভেতর ঘাপটি মেরে নেই কেউ, আচমকা ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়বে না।
গাছের ছায়ায় ছায়ায় আস্তানায় ফিরে এল ওরা। রাফিয়ানকে সিঁড়িমুখের কাছে পাহারায় বসিয়ে অন্যেরা নেমে এল ভাড়ারে।
মোম জালল কিশোর।
আগে কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়? প্রস্তাব দিল মুসা।
ভালই হয়, জিনাও রাজি।
স্যাণ্ডউইচ বের করে খেতে শুরু করল তিনজনে, কিশোর বাদে। সে ব্যাগ। খোলায় ব্যস্ত।
যা বাঁধা বেঁধেছ, ভেজা গিট কিছুঁতেই খুলতে পারল না গোয়েন্দাপ্রধান, কাটতে হবে। ছুরি বের করল সে।
বাঁধন কাটার পরেও ব্যাগের মুখ দিয়ে ভেতরের বাক্সমত জিনিসটা বের করা গেল না। দীর্ঘ পানিতে থেকে থেকে বাক্সের গায়ে আঠা হয়ে লেগে গেছে প্লাসটিকের চাদর। কেটে, ছিড়ে তারপর বের করতে হবে।
দাও তো, আমাকেও একটা দাও, হাত বাড়াল কিশোর।
একটা স্যাণ্ডউইচ দিল জিনা।
খেয়ে নিয়ে আবার চাদর কাটায় মন দিল কিশোর। ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সবাই।
স্টীলের একটা ট্রাংক বেরোল, ফাঁকগুলো রবারের লাইনিং দিয়ে এমন ভাবে বন্ধ, পানি ঢোকার পথ নেই।
তালা লাগানো নেই, নইলে আরেক ফ্যাকড়া বাধত।
ডালা তুলতে শুরু করল কিশোর। দুরুদুরু করছে সবার বুক। ঝুঁকে এসেছে ট্রাংকের চারপাশ থেকে।
ডালা তোলা হলো। ভেতরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্লাসটিকের অসংখ্য ছোট বাক্স। সব এক সাইজের।
গহনার বাক্স! হাত বাড়িয়ে একটা বাক্স তুলে নিল জিনা। ঢাকনা খুলে স্থির হয়ে গেল।
সবার চোখেই বিস্ময়।
কালো মখমলের শয্যায় শুয়ে আছে একটা অপূর্ব সুন্দর নেকলেস। মোমের আলোয় জ্বলছে যেন পাথরগুলো। নিশ্চয় কোন রানী-মহারানীর।
এটার ছবি দেখেছি আমি, বিড়বিড় করল জিনা। ফেলোনিয়ার রানীর গলায়।। তিনি পরে তার এক ভাস্তিকে জন্মদিনে প্রেজেন্ট করে দেন। ভাস্তির বর হলিউডের