আরেকবার দেখা গেল ঝিলিক। রবিনও দেখল এবার। কি ব্যাপার? সপ্রশ্ন চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।
বুঝতে পারছ না? দূরবীণ। ব্যাটারা লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ রেখেছে আমাদের ওপর। মুসা যে ডুব দিয়ে এসেছে, তা-ও দেখেছে।
তাহলে? জিনার প্রশ্ন।
তাহলে আর কি? এখন আর ডুব দেয়া চলবে না।
এখন ডুব দিতে যাচ্ছেও না। আগে বোটহাউস থেকে দড়ি আনতে হবে, তারপর…
তারপরও হবে না। ওরা আজ সারাদিন নড়বে না ওখান থেকে।
তাহলে? আবার একই প্রশ্ন করল জিনা।
রাতে চাঁদ থাকবে, বলল কিশোর। ভেরি গুড আইডিয়া, ভেলায় চাপড় মারল জিনা।
লুটের মাল নিয়ে চলে যাব আমরা সকালে। তারপর আসবে সাহেবরা, পাবে ঠনঠন। বুড়ো আঙুল দেখাল সে।
এখন সরে যাচ্ছি আমরা? মুসা জিজ্ঞেস করল।
মোটেই না, মাথা নাড়ল কিশোর। আমরা চলে গেলে ওরা এসে তুলে নিয়ে যেতে পারে। সারাদিন লেকে থাকব আমরা, ঘুরব-ঘারব। ওদের পাহারা দেব আমরা, আমাদেরকে দেবে ওরা।
দুপুরে না খেয়ে থাকব?
না। রাফিয়ানকে নিয়ে তুমি আর জিনা থাকবে ভেলায়। আমি আর রবিন গিয়ে নিয়ে আসব খাবার।
যদি আবার খাবার চুরি করে?
পারবে না। ভাড়ারের আলমারির পেছনে আরেকটা ছোট ঘর আছে, দেখেছি। আলমারির ভেতর দিয়ে ঢুকতে হয়। খুব ভালমত না দেখলে বোঝা যায় না কোন্দিক দিয়ে কিভাবে ঢুকতে হয়। ওখানে রেখে আসব।
তুমি যখন দেখেছ, ওরাও তো দেখে ফেলতে পারে, রবিন বলল।
তা পারে, সেটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। আর কি করার আছে বলো? তবে ওরা আমাদের চেয়ে বেশি উত্তেজিত, সেটা করতে যাবে বলে মনে হয় না। কাল চলে যাব বলেছি আমরা, খাবার চুরি করে রাগিয়ে দিতে চাইবে না।
যদি পিস্তল জোগাড় করে আনে? জিনার প্রশ্ন।
তাহলে আর কিছু করার থাকবে না আমাদের। দেখা ফ্রক, কি হয়।
১৫
হেসে খেলে কেটে গেল সারাটা দিন।
পশ্চিম দিগন্তে নেমে যাচ্ছে সূর্য। ডুবে গেল এক সময়। আকাশের লালিমা ঢেকে দিল এক টুকরো কালো মেঘ। শঙ্কা ফুটল জিনার চেহারায়।
ও কিছু না, সরে যাবে, আশ্বস্ত করল কিশোর।
ভেলা লুকিয়ে রেখে পাড়ে নামল ওরা। আস্তানায় ফেরার পথে চট করে একবার বোটহাউসে ঢুকে এক বাণ্ডিল দড়ি বের করে আনল মুসা।
ঠিকই অনুমান করেছে কিশোর, বৃষ্টি এল না। ঘণ্টাখানেক বাদেই পাতলা হয়ে গেল মেঘ, তারা দেখা দিল। পরিষ্কার আকাশ।
সিঁড়িমুখের কাছে রাফিয়ানকে পাহারায় রেখে অন্ধকার ভাঁড়ারে নামল ওরা। গোটা দুই মোম জ্বালল কিশোর।
না, কেউ ঢোকেনি ঘরে।
খাবার বের করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল ওরা।
শুয়ে পড়ো সবাই, বলল কিশোর। দশটা এগারোটার দিকে বেরোতে হবে।
একটা অ্যালার্ম-কুক থাকলে ভাল হত, বলল মুসা। রবিন ঠিকই বলেছিল।
আমার ঘুম আসবে না, রবিন বলল। ঠিক আছে, জেগে থাকি, সময়মত তুলে দেব তোমাদের।
ঘুম না আসুক, শুয়ে থাকো, বলল কিশোর। বিশ্রাম হবে।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা।.জিনার দেরি হলো।
চিত হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে রবিন। পাতালকক্ষে বাতাস ঢুকতে পারছে না ঠিকমত, তবু যা আসছে সিঁড়িমুখ দিয়ে, তাতেই কাঁপছে মোমের শিখা, ঘরের দেয়ালে ছায়ার নাচন। সত্যি, তাদের এই অভিযানের তুলনা হয় না। আর সে দেখেছে, যতবারই জিনা সঙ্গে থাকে, অ্যাডভেঞ্চার যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তার মনে পড়ল সেই প্রেতসাধকের কথা, সাগর সৈকতে গুপ্তধন উদ্ধারের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা, মৃত্যুখনির সেই বুক-কাঁপানো মৃত্যুহা…আর এবারকার অভিযানটাই বা কম কি? এক কাজ করবে-ভাবল সে, রকি বীচে ফিরেই কিশোরকে পটিয়ে-পাটিয়ে জিনাকেও গোয়েন্দাদের একজন করে নেবার কথা বলবে। জানে, সহজে রাজি হবে না কিশোর। আদৌ রাজি হবে কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে রবিনের, তবু বলে দেখবে। এখন আর অসুবিধে নেই। রকি বীচেই স্কুলে ভরতি হয়েছে জিনা, ইচ্ছে করলে চার গোয়েন্দা করা যায়…
এগোরোটা বাজার দশ মিনিট আগে সবাইকে তুলে দিল রবিন।
সারাদিন পরিশ্রমের পর এত আরামে ঘুমিয়েছিল, উঠতে কষ্ট হলো তিনজনেরই।
তৈরি হয়ে নিল।
বেরিয়ে এল বাইরে।
যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনি শুয়ে আছে রাফিয়ান, কিন্তু সতর্ক। সাড়া পেয়ে উঠে বসল।
আকাশে অনেকখানি উঠে এসেছে চাঁদ। উজ্জল জ্যোৎস্না। সারা আকাশ জুড়ে সাঁতার কাটছে ছোট-বড় মেঘের ভেলা। কখনও চাঁদ ঢেকে দিচ্ছে, আবছা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে বনভূমি, চাঁদ বেরিয়ে এলেই হেসে উঠছে আবার হলুদ আলোয়।
তঁাবুর কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে বলল মুসা।
না যাক, কিশোর বলল। তবু সাবধানের মার নেই। কোন রকম শব্দ করবে। এসো যাই।
গাছপালা আর ঝোপের ছায়ার পাঁচ মিনিট হাঁটল ওরা হ্রদের পাড় ধরে। চাঁদের আলোয় চকচকে বিশাল এক আয়নার মত দেখাচ্ছে হ্রদটাকে। গুনগুন করে গান ধরল মুসা, জিনাও তার সঙ্গে গলা মেলাতে যাচ্ছিল, বেরসিকের মত বাধা দিয়ে বসল কিশোর। এই চুপ চুপ, গান গাওয়ার সময় নয় এটা। ব্যাটারা শুনলে…
ভেলায় চড়ল ওরা।
সবাই উত্তেজিত, রোমাঞ্চিত। সেটা সংক্রামিত হয়েছে রাফিয়ানের মাঝেও। চঞ্চল। কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। রাতের এই অভিযান দারুণ লাগছে তার কাছে। আর কিছু করতে না পেরে এক এক করে গাল, হাত, চেটে দিতে লাগল সবার।
এক রত্তি বাতাস নেই। বড় বেশি নীরব। দাঁড়ের মৃদু ছপছপ শব্দও বেশি হয়ে কানে বাজছে। পানির ছোট ছোট ঢেউ আর বুদবুদ উঠে সরে যাচ্ছে ভেলার গা ঘেঁষে, রূপালি খুদে ফানুসের মত ফাটছে বুদবুদ্রগুলো।