পুলিশের কাছে যাচ্ছি, রাগে লাল হয়ে গেছে টিকসির মুখ, তোমরাও বাড়াবাড়ি কম করছ না। না বলে অন্যের ভেলা নিয়ে এসেছ, অন্যের বাড়িতে জোর করে ঘুমাছে, আমাদের খাবার চুরি করেছ।
আবার সেই এক কথা, হতাশ ভঙ্গিতে দু-হাত নাড়ল কিশোর। তোমরা কি করেছ? নৌকা বলে এনেছ? আমরা খাবার চুরি করেছি না তোমরা আমাদের খাবার চুরি করেছ? একটু আগে কি করলে? ধাক্কা মেরে ভেলা ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে। যাও না পুলিশের কাছে, বলো গিয়ে। আমাদেরও মুখ আছে।
ফুঁসছে ডারটি। দাঁড় তুলে নিল, ছুঁড়ে মারবে।
খবরদার, আঙুল তুলল কিশোর। অনেক সহ্য করেছি, আর না। এবার কুকুর লেলিয়ে দেব। তোমাকে ছেড়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে রাফি।
গরররর! কিশোরের কথায় সায় দিয়ে একসারি চমৎকার দাঁত ডারটিকে দেখিয়ে দিল রাফিয়ান।
দ্বিধায় পড়ে গেল দুই ডাকাত। নিচু গলায় কিছু আলোচনা করল। তারপর মুখ ফিরিয়ে গলার স্বর নরম করে টিকসি বলল, দেখো ছেলেরা, আমরা শান্তিতে ছুটি কাটাতে এসেছি, উইক-এণ্ডে। কিন্তু আমরা যেখানেই যাই দেখি তোমরা আছ, এটা আমাদের ভাল লাগে না। আসলে, আশেপাশে কেউ না থাকুক এটাই চাইছি আমরা। ঠিক আছে, একটা রফা করা যাক। তোমরা চলে যাও, আমরা তাহলে পুলিশকে কিছু বলব না। খাবার যে চুরি করেছ, একথাও না।
পুলিশের কাছে যেতে কে মানা করছে? যাও না, বলল কিশোর। রফাটফা কিছু হবে না। আমাদের যখন খুশি তখন যাব।
জ্বলে উঠল টিকসির চোখ। সামলে নিল। আবার আলোচনা করল ডারটির সঙ্গে। ফিরে জিজ্ঞেস করল, ছুটি কদিন তোমাদের? কবে যাচ্ছ?
আগামীকাল, বলল কিশোর।
আবার কিছু আলোচনা করল দুজনে।
আস্তে করে নৌকাটা কয়েক ফুট সরিয়ে নিল ডারটি। উঁকি দিয়ে পানির নিচে তাকাল টিকসি। মুখ তুলে ডারটির দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল।
ছেলেদের সঙ্গে আর একটাও কথা না বলে নৌকা নিয়ে চলে গেল ওরা।
কি করবে বুঝেছি, হাসিমুখে বলল কিশোর। কাল আমাদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। তারপর আসবে. নিরাপদে লুটের মাল তুলে নেয়ার জন্যে। টিকসি পানির দিকে তাকিয়েছিল, খেয়াল করেছ? নৌকাটা দেখেছে। আমাদের মার্কারও দেখেছে।
তাহলে এত খুশি হয়েছ কেন? জিনা বুঝতে পারছে না। নৌকাটা আমরা তুলতে পারছি না। আর আগামীকাল চলে যেতেই হচ্ছে। স্কুল মিস করা চলবে না।
দূরে চলে গেছে নৌকা, সেদিকে চেয়ে বলল কিশোর, কাল যে যাব, এটা ইচ্ছে করেই বলেছি, ওদের সরানোর জন্যে। লুটের মাল তুলে নিতে পারব আমরা।
কিভাবে? একসঙ্গে বলল অন্য তিনজন। রাফিয়ানও মুখ বাড়াল সামনে, যেন সে-ও জানতে চায়।
নৌকা তো চাই না আমরা, কিশোর বলল, চাই মালগুলো। তাহলে নৌকাটা তোলার দরকার কি? ডুব দিয়ে গিয়ে ওগুলো তুলে নিয়ে এলেই হলো। মনে হয় কোন বস্তা বা বাক্সের মধ্যে রেখেছে। ভারি না হলে এমনিতেই তোলা যাবে, আর ভারি হলে দড়ি বেঁধে টেনে তুলতে হবে।
শুনতে তো ভালই লাগছে, কিন্তু যাচ্ছে কে? হ্রদের কালো পানির দিকে চেয়ে বলল রবিন। আমার ভাই ভয় লাগে।
আমি যাব, মুসা বলল। সেদিন থেকেই তো খালি ভেলায় করে ঘুরছি। একবারও সাঁতার কাটতে পারিনি। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে। – ভালমত ভেবে দেখো, কিশোর সাবধান করল। যা ঠাণ্ডা, শেষে না নিউমোনিয়া বাধাও।
আরে দূর, পাত্তাই দিল না মুসা। পানিতে বরফ গুলে দিলেও ঠাণ্ডা লাগবে আমার।
বিশ্বাস করল সবাই। এই হ্রদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকলেও কিছু হবে না তার।
তিন-চার টানে জামাকাপড় সব খুলে ফেলল মুসা। খালি হাফপ্যান্টটা রাখল পরনে। এতই নিখুত ভাবে ডাইভ দিয়ে নেমে গেল, ঢেউ প্রায় উঠলই না। বকের মত গলা বাড়িয়ে ভেলার কিনারে ঝুঁকে এল অন্য তিনজন। দেখছে, হাত-পা নেড়ে নেমে যাচ্ছে একটা আবছা মূর্তি। কালো পানিতে কেমন যেন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে।
সময় কাটছে।
এতক্ষণ থাকে কি করে? উদ্বিগ্ন হলো রবিন। বিপদ-টিপদ…
না, বলল কিশোর। ওকে তো চেনই। অনেকক্ষণ দম রাখতে পারে। সেই যে সেবার…
হুসস করে ভেলার পাশে ভেসে উঠল মুসার মাথা। জোরে জোরে কয়েকবার শাস টেনে বলল, আছে!
কি কি দেখলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভেলার কিনার খামচে ধরে ভেসে রইল মুসা। দম নিয়ে বলল, এক ডুবে সোজা গিয়ে নামলাম নৌকায়। ভাঙা, পুরানো। তুলতে গেলে খুলে যাবে জোড়ায়, পচে গেছে। পলিথিনের একটা ব্যাগে রয়েছে মালগুলো। বেজায় ভারি। টানাটানি করেছি, তুলতে পারলাম না।
নড়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, নড়েনি।
তাহলে বেঁধে রেখেছে হয়তো। কিংবা অন্য কোনভাবে আটকে রেখেছে। দুড়ি বেঁধে দিয়ে আসতে হবে। তারপর সবাই মিলে টেনে তুলব। তবে তার আগে কিসে আটকানো রয়েছে, সেটাও খুলে দিয়ে আসতে হবে।
পানিতে বিচিত্র শিরশিরানি তুলে বয়ে গেল একঝলক বাতাস। সামান্য কাঁটা দিয়ে উঠল মুসার গা।
বাহ, ব্যায়ামবীরেরও কাঁপুনি ওঠে দেখি, হেসে বলল জিনা। বুঝলাম, তলায় কেমন ঠাণ্ডা। আমিও নামব ভাবছিলাম।
তাহলে এসো।
কাপড় আনিনি তো…ওঠো। গা মোছো।
দাঁড়াও, খানিকক্ষণ সাঁতার কেটে নিই।
না না, উঠে পড়ো, বাধা দিল কিশোর। পরে আরও ডোবাডুবি করতে হবে। বোটহাউস থেকে গিয়ে দড়ি আনতে হবে আগে। তীরের দিকে তাকাল সে।
নৌকা তীরের কাছে একটা শেকড়ে বেঁধে ওপরে উঠে গেছে দুই ডাকাত। দেখা যাচ্ছে না ওদেরকে। হঠাৎ আলোর ঝিলিক দেখতে পেল কিশোর, রোদে লেগে ঝিক করে উঠেছে কিছু।