একটু ওদিক, একটু ওদিক করে করে আবার জায়গামত আনা হলো ভেলা, আবার চারটে চিহ্ন চোখে পড়ল।
কিছু একটা মারকার ফেলে জায়গাটার চিহ্ন রাখা দরকার, টল স্টোন থেকে চোখ সরাল না কিশোর। জিনা, দেখো তো, চূড়া আর পাথরের ওপর একসঙ্গে চোখ রাখতে পারো নাকি?
দেখি চেষ্টা করে, চুড়া থেকে চোখ সরিয়ে চট করে পাথরটার দিকে তাকাল জিনা, তারপর আবার চুড়ার দিকে। কাজটা সহজ নয়। ভেলা খালি নড়ছে, স্থির রাখা যাচ্ছে না পুরোপুরি, যাবে বলেও মনে হয় না।
দ্রুত হাত চালাল কিশোর। একটা টর্চ আর পকেট-ছুরি বের করল। জিনা, তোমার ব্যাগে ফিতা আছে?
দেখো, আছে কয়েকটা, দুটো চিহ্নের ওপর চোখ রাখতে হিমশিম খাচ্ছে জিনা।
একটার সঙ্গে আরেকটা ফিতের মাথা বেঁধে জোড়া দিয়ে লম্বা করল কিশোর। ছুরি আর টর্চ এক করে ফিতের একমাথা দিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধল। তারপর ফিতে ধরে ছেড়ে দিল পানিতে, আস্তে আস্তে ছাড়তে লাগল। টান থেমে গেল এক সময়, বোঝা গেল হ্রদের তলায় পৌঁছেছে ভার।
এক হাতে ফিতে ধরে রেখে আরেক হাতে পকেট খুঁজল কিশোর। এক অলস মুহূর্তে একটা কর্ককে ছুরি দিয়ে কেটে চেচে একটা ঘোড়ার মাথা বানিয়েছিল, সঙ্গে নিয়ে এসেছে ওটা। বের করল পকেট থেকে। ফিতেটাকে টান টান করে এমন এক জায়গায় কর্ক বঁধল, যেন ওটা পানির সমতলের ঠিক নিচে ভাসে।
ভেসে রইল কর্কটা, দাঁড়ের নড়াচড়ায় আলতো ঢেউ উঠছে, তাতে লুকোচুরি খেলতে থাকল ঘোড়ার মাথা।
হয়েছে, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। চিহ্ন থেকে চোখ সরাতে পারো।
ঘোড়ার মাথাটার দিকে তাকাল মুসা। এত আগাম চিন্তা করো কিভাবে? বন্ধুর বুদ্ধির তারিফ করল সে। কিন্তু জিনিসটা বেশি ছোট। আবার খুঁজে বের করতে পারব? বড় কিছু হলে ভাল হত না?
সেটাই ভাবছি, বলল কিশোর। কিন্তু বড় আর কি আছে?
আমার মেকআপ বক্সটা ধার নিতে পারো, জিনা বলল। দাও, হাত বাড়াল কিশোর।
ব্যাগ খুলে বেশ বড় একটা প্লাসটিকের বাক্স বের করল জিনা। খুব শক্ত হয়ে লাগে ডালা, ভেতরে পানি তো ঢুকবেই না, বাতাসও ঢোকে না তেমন, বায়ুনিরোধকই বলা চলে। ভেসে থাকবে। এক এক করে লিপস্টিক, পাউডারের কৌটা, চিরুনি আর টুকিটাকি অন্যান্য জিনিস ব্যাগে রেখে বাক্সটা দিল সে।
মেয়েদের অকাজের বাক্সও অনেক সময় কাজে লাগে, ফস করে বলে ফেলল মুসা।
টান দিয়ে বাক্সটা সরিয়ে আনল জিনা। দেখো, ভাল হবে না। আমাকে রাগালে বাক্স দেব না আমি।
না না, দাও, এমনি ঠাট্টা করলাম, তাড়াতাড়ি বলল মুসা।
কর্কের পরে বাড়তি যে ফিতেটুকু রয়েছে, সেটা দিয়ে বাক্স বেঁধে পানিতে ছাড়ল কিশোর। ভেসে রইল। বোঝা যাচ্ছে, থাকবে।
ফাইন, বলল কিশোর। এবার দূর থেকেও চোখে পড়বে। দেখি তো, তলায় কি আছে?
ভেলার ধার দিয়ে ঝুঁকে চারজনেই নিচে তাকাল। কিছুই না বুঝে রাফিয়ানও গলা বাড়িয়ে দিল পানির দিকে।
অদ্ভুত এক দৃশ্য। হ্রদের তলায় বড় কালো একটা ছায়া। ছোট ছোট ঢেউয়ের জন্যে অস্পষ্ট লাগছে, কেমন কাপা কাপা, তবে নৌকা যে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ওয়াটার মেয়ার, বিড়বিড় করল মুসা।
জেরি ব্যাটা খুব চালাক, কিশোর বলল। লুটের মাল লুকানোর কি একখান জায়গা খুঁজে বের করেছে। নৌকার তলা ফুটো করে ডুবিয়েছে নিশ্চয়।
কিন্তু নৌকাটা তুলব কি করে?
তাই তো ভাবছি, থেমে গেল কিশোর। ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে রাফিয়ান।
একটা নৌকা ছুটে আসছে এদিকে, লিটল মারমেইড। টিকসি আর ডারটি দুজনেই দাঁড় বাইছে। ভেলার দিকে খেয়াল নেই, হ্রদের চারপাশের তীরের দিকে চোখ, একবার এদিক চাইছে, একবার ওদিক। বোঝা গেল, চিহ্নগুলো খুঁজছে ওরা।
তৈরি হয়ে যাও, সবাই, আস্তে বলল কিশোর। আজ আমাদের বাধা না-ও মানতে পারে।
১৪
কাছে এগিয়ে আসছে নৌকা। দাঁড় তুলে নিয়েছে টিকসি, দুই-তিনটা চিহ্নের ওপর একা চোখ রাখতে হচ্ছে তাকে। খালি মাথা ঘোরাচ্ছে এপাশ-ওপাশ।
ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে রাফিয়ান।
তার মাথায় হাত রেখে শান্ত হতে বলল জিনা।
দুই ডাকাতের অবস্থা দেখে হাসি পেল অভিযাত্রীদের। ওরা চারজন চারটে চিহ্নের ওপর চোখ রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল, আর দুজনের কতখানি অসুবিধে হবে সে তো বোঝাই যায়।
নির্দেশ দিচ্ছে টিকসি, এদিকে আরেকটু বাঁয়ে…এহহে, বেশি হয়ে গেল… ডানে-ডানে-ডানে…
কিছু বলল ডারটি।
ঝট করে মুখ ফিরিয়ে তাকাল টিকসি। ভেলাটা দেখে রাগে জ্বলে উঠল। পরক্ষণেই আবার ফিরল চিহ্নগুলোর দিকে। নিচু গলায় বলল কিছু ডারটিকে। মাথা ঝাঁকাল-ডারটি। ভীষণ হয়ে উঠেছে দুজনেরই চেহারা।
গতি বাড়ছে নৌকার, সোজা এগিয়ে আসছে।
আরে, ধাক্কা মারো। বলে উঠল রবিন।
ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল ভেলা, আরেকটু হলেই পানিতে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল রবিন, খপ করে তার হাত চেপে ধরল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, এই চোখের মাথা খেয়েছ! শয়তান কোথাকার! ভেবেছ কি?
তোরা কেন এসেছিস এখানে? গর্জে উঠল ডারটি।
রেগে গেল রাফিয়ান, দাঁতমুখ খিচিয়ে চেঁচাতে শুরু করল।
তোর বাপের জায়গা… দাড়টা তুলে নিল মুসা, রাগে কথা সরছে না।
কাঁধে হাত দিয়ে তাকে চুপ কুরুতে বুলল কিশোর। ডারটির দিকে ফিরল, রাফিয়ানের ভয়ে ধীরে ধীরে নৌকা পিছিয়ে নিচ্ছে ডাকাতটা।
দেখো, শান্তকণ্ঠে বলল গোয়েন্দাপ্রধান, তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করছ। হ্রদে অনেক জায়গা, আমাদের কাছে তোমাদের না এলেও চলে। খামোকা এসব করছ কেন?