লাফিয়ে উঠে বসল মুসা। আমেরিকা আবিষ্কার করলে নাকি?
না, লুটের মাল।
কোথায়? ঘরের চারদিকে তাকাল গোয়েন্দা-সহকারী। চোখে বিস্ময়।
আরে ওখানে না, এখানে, নকশাটায় হাত রাখল গোয়েন্দাপ্রধান। বুঝে গেছি।
১৩
এক এক করে ধরা যাক, উত্তেজনায় মৃদু কাঁপছে কিশোরের গলা। টু-ট্রীজ। এই যে, এখানে। ব্ল্যাক ওয়াটার। যেখানে লুটের মাল লুকানো রয়েছে। ওয়াটার মেয়ার। যার মধ্যে লুকানো রয়েছে। হ্রদের পানিতে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে নৌকাটা।
বলে যাও, জিনা আর রবিনকে ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে বসল মুসা।
টিকসি হয়তো জেরির পুরানো বান্ধবী, বলল কিশোর, তাহলে জেরির কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় আছে তার। নকশার মানে বুঝে ফেলেছে। বুঝেছে, কোথায় লুকানো রয়েছে নৌকাটা।
কাগজের এক জায়গায় তর্জনী দিয়ে খোঁচা মারল সে। এখন দেখি, আমরা কি বুঝেছি। টল স্টোন তো দেখেছি আমরা, নাকি? বেশ। লেকের এমন কোন জায়গা আছে, যেখান থেকে শুধু টল স্টোন নয়, টক হিল, চিমনি, স্টীপলও দেখা যাবে। চারটে জিনিসই এক জায়গা থেকে দেখা যাবে। এবং ওই জায়গায়ই লুকানো রয়েছে লুটের মাল।
অন্য তিনজন নীরব।
আমি একটা গাধা, সরল মনে স্বীকার করল মুসা। এই সহজ ব্যাপারটা বুঝলাম না। লুটের মাল রয়েছে, তারমানে ওয়াটার মেয়ারকেও ওখানেই পাওয়া যাবে। গিয়ে খালি তুলে নেয়া।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। তবে ডারটি আর টিকসির কথা ভুলো না। আমাদের আগে ওরাও গিয়ে হাজির হতে পারে, তুলে নিতে পারে জিনিসগুলো। কেড়ে নিতে পারব না, আমরা পুলিশ নই। নিয়ে সোজা চলে যাবে, রুখতেও পারব না।
সবাই উত্তেজিত।
তাহলে তো কাল ভোরেই যাওয়া উচিত, বলল রবিন। আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়ব। ডারটি আর টিকসির আগেই গিয়ে তুলে নেব। ইস, একটা অ্যালার্মব্লক থাকলে ভাল হত।
ভেলায় করে চলে যাব, মুসা বলল। বাকি তিনটে চিহ্ন খুঁজে বের করে…
তিনটে নয়, দুটো, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। চিমনিটা টু-ট্রীজেই রয়েছে। খেয়াল করোনি, এ-বাড়িটার বায়ে উঁচু একটা চিমনি?
আমি করেছি, রবিন বলল।
আরও কিছুক্ষণ পরামর্শ আর আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো, ভোরে উঠেই বেরোবে। রাত বেশি না করে শুয়ে পড়ল ওরা, নইলে সকাল সকাল উঠতে পারবে না।
সিঁড়িমুখের কাছে শুয়ে আছে রাফিয়ান, চোখ বন্ধ, কান সজাগ।
সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছে, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেরা।
কেউ বিরক্ত করল না সে-রাতে। খাবারের গন্ধে লোভ সামলাতে না পেরে চুপি চুপি এসে উঁকি দিল একবার সেই শেয়ালটা। নড়লও না. রাফিয়ান, চোখও মেলল না, চাপা গলায় গরগর করল শুধু একবার। তাতেই যা বোঝার বুঝে নিয়ে ফোলা লেজ আরও ফুলিয়ে পালাল শেয়াল মহাশয়। কর্কশ চিল্কার করে উঠল একটা হুতুম পেঁচা। ওটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কা-কা করল একটা দাড়কাক, ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
হামাগুড়ি দিয়ে এল যেন আবছা আলো, বনের কালো অন্ধকারকে কঠিন হাতে তাড়ানোর সাহস নেই বুঝি। উঠে গা ঝাড়া দিয়ে ভাঙা দরজার কাছে এগোল রাফিয়ান। তঁাবু দুটো দেখল। চোখে পড়ল না কাউকে। ফিরে এসে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এল ভাড়ারে।
সঙ্গে সঙ্গে জেগে গেল মুসা আর কিশোর।
কটা বাজে? ঘড়ি দেখেই চমকে উঠে বসল কিশোর। সাড়ে সাতটা।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। এই ওঠো ওঠো। দুপুর হয়ে গেছে।
দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে, দাঁত মেজে, চুল আঁচড়ে নিল ওরা। পরনের কাপড় ঝেড়ে নিল হাত দিয়ে। তাড়াতাড়ি খাবার বেড়ে দিল রবিন আর জিনা। নাকেমুখে কোনমতে খাবারগুলো খুঁজে দিয়ে সিংকের কল থেকে পানি খেলো।
বেরোনোর জন্যে তৈরি।
তাবুর কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
গুড, বলল কিশোর। ঘুম থেকে ওঠেনি। আমরাই আগে যাচ্ছি।
ভেলায় চড়ে বসল অভিযাত্রীরা। দাঁড় তুলে নিল হাতে। সবাই উত্তেজিত, রাফিয়ানও।
আগে টল স্টোনটা বের করি, ঝপাত করে পানিঙে দাঁড় ফেলল কিশোর।
হ্রদের মাঝখানে চলে এল ওরা। টল স্টোন চোখে পড়ছে না। চেয়ে চেয়ে চোখ ব্যথা করে ফেলল। গেল কোথায় উঁচু পাথরটা?
সবার আগে দেখল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, ওই যে, ওইই, উঁচু গাছগুলোর পরে…
টল স্টোন তো পাওয়া গেল, বলল কিশোর। এই, তোমরা উল্টোদিকে চাও তো, টক হিল দেখা যায় কিনা? কোন পাহাড়-টাহাড়? আমি টল স্টোনের ওপর চোখ রাখলাম। দরকার হলে ভেলটা সামনে পেছনে কোরো।
টক হিলও মুসাই আগে দেখল। পেয়েছি। বলল সে। ওটাই। দেখো দেখো, অদ্ভুত একটা পাহাড়, পিরামিডের মত চূড়া: কিশোর, টল স্টোন এখনও দেখা যাচ্ছ?
হ্যাঁ, বলল কিশোর। তুমি পাহাড়টা থেকে চোখ সরিও না। জিনা, দেখো তো স্টীপল দেখা যায় কিনা? টল স্টোনের ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না সে। দেখো, পুরানো বাড়ি, গির্জা, মন্দিরের চূড়া বা স্তম্ভ…
দেখেছি, দেখেছি! এত জোরে চেঁচিয়ে উঠল জিনা, যার যার চিহ্ন থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল মুসা আর কিশোর। রবিন আগেই সরিয়েছে।
সকালের রোদে ঝলমল করছে গির্জার পাথরে তৈরি চুড়া।
চমৎকার, বলল কিশোর। রবিন, দেখো তো, চিমনিটা দেখা যায়?
না, রবিন বলল। মুসা আরেকটু বাঁয়ে সরাও…আরেকটু…হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি। আর না, আর না…।
দাঁড় বাওয়া বন্ধ। কিন্তু এক জায়গায় স্থির থাকল না ভেলা, আপনগতিতে অল্প অল্প করে সরে গেল। পানিতে বার দুই দাঁড়ের খোঁচা মেরে আবার সরাতে হলো ভেলাটা। ইতিমধ্যে গির্জা হারিয়ে ফেলেছে জিনা।