পানির কিনারে পাড়ের ওপর গড়িয়ে ওঠা বড় বড় গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে চলে গেছে রবিনের নজর। সিঁদুর-লাল আকাশ। মাইলখানেক দূরের পাহাড়ী ঢালে বিশেষ একটা জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার।
উঁচু একটা পাথর।
সেটার দিকে হাত তুলে বলল রবিন, কিশোর, দেখো? ওই যে পাথরটা। সীমানার চিহ্ন? অনেক বড় কিন্তু।
কই? কিশোর বলল। ও, ওটা? কি জানি, বুঝতে পারছি না।
অনেক লম্বা… বলতে গেল মুসা।
কথাটা ধরে ফেলল কিশোর। কি যেন মনে পড়ে গেছে। লম্বা! টল স্টোন। নকশায় লেখা রয়েছে না?
হ্যাঁ, তাই তো, মাথা ঝাঁকাল মুসা। চেয়ে আছে দূরের পাথরটার দিকে।
চার জোড়া চৌখই এখন ওটার দিকে। ভেলা চলছে। আস্তে আস্তে গাছপালার আড়ালে হারিয়ে গেল পাথরটা।
টল স্টোন, আবার বিড়বিড় করল কিশোর। ভুলেই গিয়েছিলাম।
তোমার কি মনে হয়, জিনা বলল, ওটার তলায়ই লুকানো আছে লুটের মাল?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। হয়তো একটা দিক-নির্দেশ…এই, জলদি বাও। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার, রাতের আগে।
১২
বোটহাউসে ঢুকল ভেলা। খুঁটিতে আগের জায়গায় বাঁধা রয়েছে লিটল মারমেইড, ডারটি আর টিকসি নেই।
গেল কোথায়? টর্চ জ্বেলে দেখছে কিশোর। শোনো, ভেলাটা এখানে রাখা ঠিক না। চলো, কোন ঝোপের তলায় লুকিয়ে রাখি।
ঠিকই বলেছে কিশোর। অন্যেরাও একমত হলো। হাত অবশ হয়ে গেছে। তবু কোনমতে ভেলাটা আবার বের করে এনে পানির ওপর এসে পড়া কিছু ডালপাতার তলার শেকড়ে শক্ত করে বাঁধল।
লতা আর শেকড় ধরে ধরে পাড়ে উঠে রওনা হলো আস্তানায়। চোখ চঞ্চল দুই ডাকাতকে খুঁজছে। ছায়াও দেখা যাচ্ছে না ওদের। পোড়া বাড়িতে ভাড়ারে ঢুকে বসে নেই তো?
আগে রাফিয়ানকে ঢুকতে বলল ওরা।
সিঁড়িমুখে মাথা ঢুকিয়ে দিল রাফিয়ান। শব্দ করল না। সিঁড়ি টপকে নেমে গেল নিচে।
নেমেই গোঁ গোঁ করে উঠল।
কি ব্যাপার? বলল কিশোর। বসে আছে নাকি নিচে?
মনে হয় না, মাথা নাড়ল জিনা। অন্য কিছু। কী?
চলো না, নেমেই দেখি, সিঁড়িতে পা রাখল জিনা।
বিছানা যেভাবে করে রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে। ব্যাজ আর কাপড় চোপড়ও রয়েছে জায়গামত। মোম জ্বেলে টর্চ নিভিয়ে দিল কিশোর।
কি হয়েছে, রাফি? জিজ্ঞেস করল জিনা। এমন করছিস কেন?
গোঙানি থামছে না রাফিয়ানের।
গন্ধ পেয়েছে নাকি? চারপাশে তাকিয়ে বলল মুসা। ওরা এসেছিল এখানে?
আসতেও পারে, রবিন বলল।
মরুকগে, হাত নাড়ল মুসা। খিদে পেয়েছে। কিছু খেলে কেমন হয়?
ভালই হয়, আমারও খিদে পেয়েছে, বলতে বলতে আলমারির দিকে এগোল কিশোর। কিন্তু টান দিয়ে দরজা খুলেই স্থির হয়ে গেল।
নেই!
অথচ ওখানেই রেখে গিয়েছিল সব খাবার। থালা-বাসন, প্লেট-কাপ, সব সাজানোই রয়েছে আগের মত, নেই শুধু খাবারগুলো। রুটি নেই, বিস্কুট নেই, চকলেট নেই…কিচ্ছু নেই।
কিশোরের ভাব দেখেই বুঝল অন্যেরা, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। এগোল আলমারির দিকে।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। কিছুই তো নেই। একটা বিস্কুটও না। ইস আগেই ভাবা উচিত ছিল। আল্লাহরে, কি খেয়ে বাঁচি এখন!।
খুব চালাকি করেছে, রবিন বলল। জানে, খাবার ছাড়া থাকতে পারব না এখানে। আমাদের তাড়ানোর এটাই সবচেয়ে ভাল কৌশল। রাতে খিদেয় মরব, সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে গায়ে, অনেক সময় পাবে ওরা।
মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে তালমারির কাছেই বসে পড়ল মুসা। গায়ে। যাওয়ারও সময় নেই এখন। যা পথ-ঘাট, অন্ধকার! উফ, খিদেও পেয়েছে। নাহ্ রাতটা টিকব না।
মন খারাপ হয়ে গেছে সবার। কতক্ষণ আর খিদে সওয়া যায়? ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর, ভেবেছিল খেয়েদেয়ে চাঙা হবে, তার আর উপায় নেই।
বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। একবার ভেবে ছিলাম, কয়েকটা চকলেট সরিয়ে রেখে যাই, রাখলাম না…রাফি, ওভাবে আলমারির দিকে চেয়ে লাভ নেই। কিচ্ছু নেই ওতে।
আলমারি শুকছে, আর করুণ চোখে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে রাফিয়ান।
হারামীগুলো কোথায়? হঠাৎ রেগে গেল কিশোর। ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। বুঝিয়ে দেয়া দরকার লোকের খাবার চুরি করার ফল।
হুফ, পুরোপুরি একমত হলো রাফিয়ান।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল কিশোর। দুই ডাতাক কোথায়? ভাঙা, শূন্য দরজার কাছে গিয়ে দূরে তাকাল।
বনের মাঝে এক জায়গায় দুটো তাবু খাটানো হয়েছে। তাহলে ওখানেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে, ভাবল সে। চোরগুলোকে গিয়ে গালাগাল করে আসবে নাকি? হ্যাঁ, তাই যাবে।
আয়, রাফি, বলে পা বাড়াল কিশোর।
কিন্তু তাঁবুতে কেউ নেই। কয়েকটা কম্বল, একটা প্রাইমাস স্টোভ, একটা কেটলি আর অন্যান্য কিছু দরকারী জিনিস অগোছাল হয়ে পড়ে আছে। একটা তাঁবুর কোণে গাদা করে রাখা আছে কি যেন, কাপড় দিয়ে ঢাকা।
টিকসি আর ডারটি গেল কোথায়?
খুঁজতে বেরোল কিশোর।
পাওয়া গেল হ্রদের ধারে গাছের তলায়, পায়চারি করছে। কথা বলছে। বাহ, সান্ধ্যভ্রমণ, মুখ বাঁকাল সে। দাঁড়িয়ে পড়ল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে, ভাবছে কিছু। যে কাজে এসেছিল, সেটা না করে ফিরে চলল আস্তানায়।
পেছনে রাফিয়ান, বাতাসে কি যেন শুকতে শুকতে চলেছে।
তাঁবু খাঁটিয়েছে, বন্ধুদের জানাল কিশোর। ব্যাটারা রয়েছে লেকের পাড়ে। লুটের মাল না নিয়ে যাবে না।
আরে রাফি কোথায়? সিঁড়িমুখের দিকে চেয়ে আছে জিনা। কিশোর, কোথায় ফেলে এলে ওকে?