দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, নৌকাটার দিকে ইশারা করে বলল জিনা। খুঁজছে। কিশোর, কি মনে হয়? আমাদেরটার মতই মেসেজ আছে ওদের কাছে? ইস্ যদি দেখতে পারতাম।
কিশোরের নির্দেশে দাঁড় বাওয়া বন্ধ করল মুসা আর টিকসি। এতই ঝুঁকেছে, কপালে কপাল লেগে গেছে প্রায়।
আস্তে দুই টান দাও তো, বলল কিশোর। আরেকটু কাছে এগোই। দেখি, কি দেখছে ব্যাটারা।
নৌকার একেবারে পাশে চলে এল ভেলা। ঘেউ ঘেউ করে উঠল রাফিয়ান। চমকে মুখ তুলে তাকাল দুই ডাকাত। ছেলেদের দেখে কালো হয়ে গেল মুখ।
হাল্লো, দাঁড় তুলে নাড়ল মুসা, হাসি হাসি মুখ। চলেই এলাম। খুব ভাল চলছে ভেলা। তোমাদের নৌকা কেমন?
রাগে লাল হয়ে গেল টিকসির মুখ। চেঁচিয়ে বলল, কাকে বলে ভেলা বের করেছ? বিপদে পড়বে।
তাই তো জিজ্ঞেস করতে এলাম, কিশোর বলল, তোমরা কাকে জিজ্ঞেস করে নৌকা বের করেছ। গিয়ে অনুমতি নিয়ে আসব তার কাছ থেকে।
হেসে উঠল জিনা, গা জ্বালিয়ে দিল দুই ডাকাতের।
কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে রাগে ফুলতে শুরু করল টিকসি। ডারটির ভাব দেখে মনে হলো, দাড়ই ছুড়ে মারবে কিশোরের মুখে। গর্জে উঠল, কাছে আসবি না বলে দিলাম। মেরে তক্তা করে দেব।
রাগ করছ কেন, ভাই? মোলায়েম গলায় বলল মুনা। আমরা তো ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে এলাম। ভাব করে নেওয়া ভাল না?
আবার হেসে উঠল জিনা, বিছুটি ডলে লাগাল যেন ডাকাতদের চামড়ায়। .
পারলে ছেলেদের এখন টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে ওরা। কিন্তু সামলে নিল টিকসি। নিচু গলায় দ্রুত কিছু পরামর্শ করল ডারটির সঙ্গে। রাগে বার দুই মাথা ঝাঁকাল গরিলাটা, কিন্তু শেষে মেনে নিল টিকসির কথা। পঁাড় তুলে নিয়ে ঝপাং করে ফেলল পারিতে, দ্রুত বেয়ে চলল।
চালাও, বলল কিশোর। পিছু নাও, সে-ও নিষ্ক্রিয় রইল না আর, অসুবিধে করে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে চায় দাঁড় বাওয়ায়। …
পশ্চিম তীরের দিকে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে ডারটি। ভেলাটাও পিছে লেগে রইল। মাঝপথেই সাঁই করে নৌকার মুখ ঘোরাল।
নৌকা হালকা, ভেলা ভারি, চলনও নৌকার চেয়ে ভারি। ফলে, চারজনে বেয়েও একজনের সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ঘনঘন ওঠানামা করছে বুক।
ডান তীরে নৌকা নিয়ে গেল ডারটি। ভেলাটা কাছাকাছি হওয়ার অপেক্ষায় রইল।
ভাল এক্সারসাইজ, তাই না? ডেকে বলল টিকসি। স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল।
আবার হ্রদের মাঝখানে রওনা দিল নৌকা।
খাইছে! হুঁসস করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল মুসা। হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার। কি করছে ব্যাটারা?
খামোকা খাঁটিয়ে নিচ্ছে, দাঁড় তুলে ফেলেছে কিশোর। আমরা থাকলে জলঘোটকীকে আর খুঁজবে না। খেলাচ্ছে আমাদের।
তাহলে আর খেলতে যাচ্ছি না আমি, বুড়ো আঙুল নাড়ল মুসা। দাঁড় তুলে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, হাঁপাচ্ছে।
অন্যেরাও বিশ্রাম নিতে লাগল।
বন্ধুদের অবস্থা দেখে করুণা হলো যেন রাফিয়ানের, উঠে এসে এক এক করে গাল চেটে দিল চারজনেরই। তারপর ভুল করে বসে পড়ল জিনার পেটের ওপর।
হেই রাফি! আরে, দম বন্ধ হয়ে গেল তো আমার। কুকুরটাকে জোরে ঠেলে দিল জিনা। ভারিও বটে! বাপরে বাপ!
খুব অন্যায় হয়ে গেছে, বুঝতে পারল রাফিয়ান। আরেকবার জিনার গাল চেটে দিতে গেল।
এত বেশি শ্রান্ত, এসব ভাল লাগছে না জিনার। থাপ্পড় দিয়ে সরিয়ে দিল কুকুরটার মুখ।
নৌকাটা কই? উঠে বসে দেখার শক্তিও নেই যেন রবিনের।
গোঙাতে গোঙাতে উঠে বসল কিশোর। ওফফ, বিকৃত করে ফেলল মুখ, পিঠটা গেছে। ব্যথাআ! গেল কই হতচ্ছাড়া নৌকা…ও, ওই যে, খালের দিকে যাচ্ছে। আপাতত জলঘোটকী খোঁজা বাদ।
আমাদেরও বাদ দেয়া উচিত, হাতের পেশী টিপতে টিপতে বলল রবিন। যা ব্যথা হয়েছে, কালও বেরোতে পারব কিনা…হেই রাফি, সর! আমার ঘাড়ে কি মধু? যা, চাটতে হবে না।
চলো, আমরাও ফিরে যাই, বলল কিশোর। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর নৌকা খোঁজার সময় নেই।
চলো, জিনা বলল। দাঁড়াও আরেকটু জিরিয়ে নিই। আরি, আবার বসল দেখি পায়ের ওপর….এই রাফি, সর। লাথি মেরে ফেলে দেব কিন্তু পানিতে।
কিন্তু লাথি আর মারতে হলো না। পানিতে পড়ার শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠে বসল জিনা। ভেলায় নেই রাফিয়ান।
পানিতে সাঁতার কাটছে। খোশমেজাজেই আছে।
কি আর করবে বেচারা? হেসে বলল মুসা। সবাই খালি দূর দূর করছ। ভেলায় নেই জায়গা। বসবে কোথায় ও? মনের দুঃখে তাই আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়োতে চাইছে।
তুমি ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছ, রেগে উঠল জিনা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা। খেয়েদেয়ে তো আর কাজ নেই আমার।
তাহলে পড়ে কি করে?
আমি কি জানি?
দেখো, আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলবে না…
তো কিভাবে…
আহ, কি শুরু করলে? ধমক দিল কিশোর। চুপ করো। রাফিকে টেনে তোলা দরকার। নিজে নিজে উঠতে পারবে না ও।
টেনেহিঁচড়ে ভেলায় তোলা হলো রাফিয়ানকে। মুসাই সাহায্য করল বেশি। লজ্জিত হয়েছে জিনা। এখন আবার মুসার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে।
উঠেই জোরে গা ঝাড়া দিল রাফিয়ান। পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিল সবার চোখমুখ। এহহে, পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে হেসে উঠল রবিন, ব্যাটা নিজেও ভিজেছে, আমাদেরও ভেজাচ্ছে।
দেখতে দেখতে আবার সহজ হয়ে এল ওরা। তখন এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, মেজাজ ঠিক রাখতে পারছিল না কেউই।
খুব সুন্দর বিকেল। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে কিশোরের চোখ। ধীরে ধীরে দাঁড় টানছে জিনা আর মুসা। হ্রদের কালচে নীল পানিতে ঢেউয়ের রিঙ তৈরি হচ্ছে, বড় হতে হতে ছড়িয়ে গিয়ে ভাঙছে সোনালি ঝিলিক তুলে। ভেলার দুপাশেও সোনালি : ফেনা। পাশে সঁতার কাটছে দুটো জলমোরগ, বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা ঘোরাচ্ছে আর কিক কিক করছে, আসছে ভেলার সঙ্গে সঙ্গে।