মহিলার কথায় এক সঙ্গে তার দিকে ঘুরে গেল চার জোড়া চোখ। জেলখানায়? কয়েদী? কোন জেলে?
ওদের মনের কথা বুঝে হাসলেন মহিলা। না না, রিক কয়েদী নয়। ওয়ারডার। খুব ভাল ছেলে আমার। ওর চাকরিটা আমার মোটেই ভাল্লাগে না। চোর-ডাকাতের সঙ্গে বাস, কখন কি হয়!
হ্যাঁ, ম্যাপে দেখলাম, বলল কিশোর। বড় একটা জেলখানা আছে এদিকে। আমরা ওটার ধারে-কাছেও যাব না।
না, যেয়ো না, মহিলাও হুশিয়ার করলেন, ঢুকে গেলেন ভেতরে।
দাঁড়িয়ে আছে ছেলেরা। অনেকক্ষণ। মাত্র একজন খরিদ্দারের দেখা পেল। বিষণ্ণ চেহারার এক বৃদ্ধ, পাইপ টানতে টানতে ঢুকল। দোকানের চারদিকে তাকিয়ে মহিলাকে খুঁজল। তারপর এক প্যাকেট পাউডার নিয়ে পকেটে ঢোকাল। কিশোর লক্ষ করল, পাউডারটা পাচড়ার ওষুধ।
পকেট থেকে পয়সা বের করে কাউন্টারে ফেলল লোকটা। পাইপ দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেই বলল, মহিলাকে বোলো, নিয়ে গেলাম, বেরিয়ে গেল সে। –
লোকটার গায়ে-কাপড়ে দুর্গন্ধ, কদিন গোসল করে না, কাপড় ধোয় না কে জানে। বুড়োর ভাবভঙ্গি আর গন্ধ কোনটাই পছন্দ হলো না রাফিয়ানের, চাপা গোঁ গো করে উঠল।
অবশেষে স্যাণ্ডউইচ তৈরি শেষ হলো। বেরিয়ে এলেন মহিলা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সুন্দর করে প্যাকেট করে দিলেন সব খাবার, প্রতিটি প্যাকেটের ওপর পেনসিল দিয়ে লিখে দিলেন কোনটাতে কি আছে। পড়ে, অন্যদের দিকে চেয়ে চোখ টিপল মুসা, ঝকঝকে সাদা দাঁত আর একটাও লুকিয়ে নেই, বেরিয়ে পড়েছে। হাসিতে। খাইছে! আল্লাহরে, নিশ্চয় কোন পুণ্য করে ফেলেছিলাম। এত খাবার?… আরে, ওটাতে কি?
ফ্রুট কেক, হেসে বললেন মহিলা। বেশি নেই, চার টুকরো ছিল। দিয়ে দিলাম। ফাউ। পয়সা লাগবে না। খেয়ে ভাল লাগলে ফেরার পথে জানিয়ে যেয়ো।
অনেক চাপাচাপি করেও কেকগুলোর জন্যে পয়সা দিতে পারল না কিশোর। কাউন্টারের দিকে চোখ পড়তেই বললেন, পয়সা এল কোত্থেকে?
বলল কিশোর।
ও, রিকেট বুড়ো, মাথা দোলালেন মহিলা। ঠিক আছে, তোমাদের যাত্রা শুভ হোক। ফেরার পথে দেখা করে যেয়ো। আর, খাবারের দরকার পড়লেই চলে এসো এখানে।
ঘাউ! মহিলার কথা বুঝেই যেন সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল রাফিয়ান, দরজার বাইরে থেকে।
ও, তুই। ভুলেই গিয়েছিলাম। রান্নাঘর থেকে বেশ বড় এক টুকরো হাড় এনে ছুঁড়ে দিলেন কুকুরটার দিকে।
মাটিতে আর পড়তে পারল না। শূন্যেই লুফে নিল রাফিয়ান।
মহিলাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
২
আহ, ছুটির কি আনন্দ! অনেক পেছনে ফেলে এসেছে স্কুল। অক্টোবরের রোদে উষ্ণ আমেজ। শরতের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে প্রকৃতি, গাছে গাছে হলুদ, লাল, সোনালি রঙের সমারোহ। রোদে যেন জ্বলছে। জোরে বাতাস লাগলে বোটা থেকে খসে, যাচ্ছে মরা পাতা, ঢেউয়ে নৌকা যেমন দোলে, তেমনি দুলতে দুলতে নামছে মাটিতে।
ছোট্ট যে গাঁয়ে বাস থেকে নেমেছিল ওরা, সেটা পেছনে ফেলে এল। খুব ভাল লাগছে হাঁটতে। আঁকাবাঁকা সরু পথে নেমেছে এখন। দু-ধারে পাতাবাহারের ঝাড় এত ঘন হয়ে জন্মেছে, আর এত উঁচু, ওপর দিয়ে দেখা যায় না ওপাশে কি আছে। মাথার ওপরে ডালপাতা দু-পাশ থেকে এসে গায়ে গায়ে লেগে চাদোয়া তৈরি করে দিয়েছে, তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুইয়ে আসছে যেন আলো।
এ-তো দেখি একেবারে সুড়ঙ্গ, বলল মুসা। নাম কি জায়গাটার?
এটার নাম কি ঠিক বলতে পারছি না, বলল কিশোর। তবে এটা হরিণ পাহাড়ে চলে গেছে।
হরিণ পাহাড়? ভুরু কোঁচকাল রবিন। ডিয়ার হিল। বাংলা করলে হরিণ পাহাড়ই পঁড়ায়, নাকি?
হ্যাঁ, তা হয়, তার বাংলা শব্দের সীমিত ভাণ্ডার খুঁজল রবিন। শুনতেও ভাল লাগছে।
ঐখানের নামগুলোই সুন্দর। অন্ধ উপত্যকা, হরিণ পাহাড়, কুয়াশা হ্রদ, হলুদ দীঘি, ঘুঘুমারি…
ওফ, দারুণ তো! বলে উঠল জিনা। অরিজিনাল নামগুলো কি?
ব্লাইন্ড ভ্যালি, ডিয়ার হিল, মিসটি লেক, ইয়েলো পণ্ড, ডাভ ডেথ…
অপূর্ব! বলল রবিন। বাংলা ইংরেজি দুটোই।
বাংলাটাই থাক না তাহলে? দ্বিধা করছে কিশোর, যার যার মাতৃভাষা তার কাছে প্রিয়, বন্ধুরা আবার কি মনে করে। বাইরের কারও সঙ্গে বলার সময় লাগছেন করুক, ইংরেজিই বলতে হবে, আমরা নিজেরা নিজেরা…
আমি রাজি। আমার কাছে বাংলাই ভাল লাগছে, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা। নিজের ভাষা কিছু কিছু জানি, কিন্তু সেটা না জানারই শামিল, বাংলার চেয়েও কম জানি। সেই কবে কোন কালে আফ্রিকা ছেড়ে চলে এসেছিল আমার দাদার দাদা…ভুল বললাম, চলে আসেনি, জোর করে ধরে আনা হয়েছিল, গোলাম করে রাখার জন্যে…শ্বেতাঙ্গরা…
আড়চোখে জিনার দিকে চেয়ে তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর, থাক থাক, পুরানো ইতিহাস ঘাটাঘাটির দরকার নেই, ঝগড়া লেগে যাবে এখন। ছুটির আনন্দই মাটি হবে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম…
কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে ওরা।
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল রাফিয়ান। খরগোশের গন্ধ পেয়েছে।
আরিব্বাপরে! জিন অবাক। এত্তো খরগোশ! এই দিনের বেলায়? আমার গোবেল দ্বীপেও তো এত নেই।
হরিণ পাহাড়ে এসে উঠল ওরা। বসল, খরগোশ দেখার জন্যে। রাফিয়ানকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল, কিছুঁতেই আটকে রাখা যাচ্ছে না। খরগোশের গন্ধে পাগল হয়ে গেছে যেন সে। এক ঝাড়া দিয়ে জিনার হাত থেকে বেল্ট ছুটিয়ে নিয়েই দিল দৌড়।
রাফি! রাফি! চেঁচিয়ে উঠল জিনা।