চমত্তার বুদ্ধি, আঙুলে চুটকি বাজাল জিনা। দারুণ সুন্দর বিকেল। হদে ভেলা ভাসিয়ে দাঁড় টানা…আউফ! এখুনি বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
আমারও, মাথা কাত করল মুসা। ভেলাটা আমাদের ভার সইতে পারলেই হয়.জিনা, আরেক টুকরো কেক দাও তো। বিস্কুট আছে?
অনেক, জবাব দিল রবিন। চকলেটও আছে।
খুব ভাল, এক কামড়ে এক সুইস কেকের অর্ধেকটা কেটে নিয়ে চিবাতে শুরু করল মুসা। এখানেই থাকতে হবে মনে হচ্ছে। খাবারে টান না পড়লেই বাঁচি।
যে হারে গেলা শুরু করেছ, জিনা ফোড়ন কাটল, শেষ না হয়ে উপায় আছে? বিদেশ-বিভুঁই, খাবারের সমস্যা আছে, একটু কম করে খাও না বাবা…
জিনা, হাত বাড়াল কিশোর, জগটা দাও তো, পানি নিয়ে আসি। আর রাফির জন্যে কি দেবে দাও।
ধীরে সুস্থে পুরো আধ ঘণ্টা লাগিয়ে লাঞ্চ শেষ করল ওরা। এবার বোটহাউসে গিয়ে ভেলা নিয়ে বেরোনো যায়।
বোট হাউসের দিকে রওনা হলো ওরা।
হদের দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল কিশোর, দেখো দেখো, ওই যে। নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে ব্যাটারা। নিশ্চয় জলকুমারী, ওটাই একমাত্র ডোবেনি। শিওর, জলঘোটকীকে খুঁজছে ওরা।
দাঁড়িয়ে গেল সবাই। মুসার মুখ গোমড়া হয়ে গেল। এত কষ্ট কি শেষে মাঠে মারা যাবে? তাদের আগেই ওয়াটার মেয়ারকে পেয়ে যাবে ওই দুই ডাকাত? ওরা কি জানে, নৌকাটা কোথায় লুকানো।
দেয়ালের ফোকর দিয়ে বোটহাউসে ঢুকল ওরা। সোজা এগোল ভেলার দিকে। ঠিকই আন্দাজ করেছে কিশোর, লিটল মারমেইডকেই নিয়ে গেছে।
ভেলার কোণার চার ধারে দড়ির হাতল লাগানো রয়েছে, ধরে নামানোর জন্যে। চারজনে চারটে হাতল ধরে ভেলাটা তুলে নিয়ে চওড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। সতর্ক রয়েছে, ভারের চোটে না আবার ভেঙে পড়ে পুরানো সিঁড়ি।
ভাঙল না। পানির কিনারে চলে এল ওরা।
এবার ছাড়ো, বলল কিশোর। আস্তে।
যতটা পারল আস্তেই ছাড়ল ওরা, কিন্তু ভারি ভেলা। ঝপাত করে পড়ল পানিতে, পানি ছিটকে উঠে ভিজিয়ে দিল ওদের শরীর।
দাঁড়গুলো খুলে নিয়ে এসো, এক কোণার হাতল ধরে রেখেছে কিশোর, নইলে ভেসে যাবে ভেলা। জলদি।
১১
ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের দাঁড় ঝোলানো রয়েছে দেয়ালে। ভেলা বাওয়ার জন্যে বিশেষভাবে তৈরি চারটে ছোট দাড়ি রয়েছে ওগুলোর মধ্যে। খুলে নিয়ে আসা হলো ওগুলো।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে রাফিয়ান। কোন কাজে সহায়তা করতে পারছে না। খারাপ লাগছে তার, বুঝিয়ে দিচ্ছে ভাবেসাবে।
কোণের হাতল ধরেই রয়েছে কিশোর। দাঁড় হাতে আগে উঠল মুসা। বালিতে দাড়ের ঠেকা দিয়ে ভেলা আটকাল। এরপর উঠল জিনা। দুজনেই দাঁড় বাওয়ায় ওস্তাদ। রবিন উঠল। সব শেষে উঠল কিশোর…না না, ভুল হলো, রাফিয়ানের আগে উঠল সে।
রাফি, আয়, হাত নেড়ে ডাকল জিনা। এ-রকম নৌকায় চড়িসনি আগে, কিন্তু অসুবিধে হবে না। আয়।
সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পানির কিনারে নেমে এল রাফিয়ান। কালো পানি শুকল একবার, পছন্দ হচ্ছে না। তবে আর ডাকের অপেক্ষা করল না। মস্ত এক লাফ দিয়ে হঠাৎ করে এসে পড়ল ভেলায়।
জোরে ঝাঁকি দিয়ে এক পাশে কাত হয়ে গেল ভেলা।
দ্রুত আরেক পাশে একেবারে কিনারে চলে গেল রবিন, ভারসাম্য ঠিক করল। হেসে বলল, চুপ করে বোস। যা একখান বপু তোমার, নড়াচড়ারই আর জায়গা নেই। ডুবিয়ে মেরো না সব্বাইকে।
রবিনের কথায় কিছু মনে করল না রাফিয়ান। চুপ করে বসল।
বালিতে দাঁড়ের মাথা ঠেকিয়ে লগি-ঠেলার মত করে ভেলাটাকে বোটহাউস থেকে বের করে আনতে শুরু করল মুসা। জিনাও হাত লাগাল। বোটহাউসের মুখের লতাপাতা অনেকখানি পরিষ্কার করে নিয়েছে দুই ডাকাত, নৌকা বের করার সময়। কাজেই ছেলেদের আর কিছু পরিষ্কার করতে হলো না। সহজেই খালে বেরিয়ে এল ওরা।
শান্ত পানি, ভেলাটাও শান্তই রইল। ঢেউ থাকলে অসুবিধে হত, বোঝা বেশি।
এক সঙ্গে দাঁড় বেয়ে চলল চারজনে।
রাফিয়ান দাঁড়িয়ে দেখছে। ভেলার পাশ দিয়ে সাঁ সঁ করে সরে যাচ্ছে পানি, বেশ মজা পাচ্ছে সে। ভাবছে বোধহয়, এটাও কোন ধরনের নৌকা। সাবধানে সামনের এক পা বাড়িয়ে পানি ছুঁল সে, ঠাণ্ডা, সুড়সুড়ি দিল যেন পায়ে। কুকুরে-হাসি হেসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে, ভোতা নাকটা পানি ছুঁই ছুঁই করছে।
মজার কুকুর তুই, রাফি, বলল রবিন। শুয়েছিস, ভাল। দেখিস, লাফিয়ে উঠিস না হঠাৎ। ভেলা উল্টে যাবে।
খালের মুখের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ভেলা। নৌকাটা দেখা যাচ্ছে না।
ওই যে, ভেলা আরও খানিক দূর এগোনোর পর হাত তুলল কিশোর। হ্রদের মাঝেই আছে এখনও নৌকাটা। লিটল মারমেইড। পিছু নেব নাকি? দেখব কোথায় যায়?
অসুবিধে কি? বলল মুসা।
জোরে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করল সবাই। দুলে উঠল ভেলা।
আরে, ও কি করছ? কিশোরকে বলল মুসা। উল্টোপাল্টা ফেলছ তো। ভেলা এগোবে না, ঘুরবে খালি। এভাবে ফেলো, এই এভাবে, দেখিয়ে দিল সে।
যতই দেখিয়ে দেয়া হোক, বিশেষ সুবিধে করতে পারল না কিশোর আর রবিন। বিরক্ত হয়ে শেষে বলল মুসা, না পারলে চুপ করে বসে থাকো। আমি আর জিনাই পারব। খালি খালি অসুবিধে করবে আরও।
সানন্দে হাত গুটিয়ে বসল কিশোর। দাঁড় বাওয়ার চেয়ে মাথা খাটানো অনেক
বেশি পছন্দ তার। তা-ই করল।
জিনা আর মুসাও খুব খুশি, মনের মত কাজ পেয়ে গেছে। ঘেমে উঠছে শরীর। উষ্ণ কোমল রোদ, বাতাস নেই, শরতের নির্মল বিকেল।