জিনা আর রাফিয়ান একসঙ্গে লাফিয়ে বেরোল, তাদের পেছনে এল রবিন।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল দুই ডাকাত। দ্রুত কি যেন বলল একে অন্যকে। ভুরু কুঁচকে তাকাল লোকটা।
বকবক করতে করতে ওদের দিকে এগোল ছেলেরা।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মেয়েমানুষটা, কে তোমরা? এখানে কি করছ?
বেড়াতে এসেছি, জবাব দিল কিশোর। ঘোরাফেরা করছি। স্কুল ছুটি।
এখানে কেন এসেছ? এটা প্রাইভেট প্রপার্টি।
তাই নাকি? বোকার অভিনয় শুরু করল কিশোর। পোড়া, ভাঙাচোরা বাড়ি, জঙ্গল:যার খুশি এখানে আসতে পারে। আসলে লেকটা দেখতে এসেছি। খুব নাম শুনেছি তো।
পরস্পরের দিকে তাকাল দুই ডাকাত। ছেলেদের দেখে অবাক হয়েছে, বোঝা যায়।
কিন্তু এ-হ্রদ দেখতে আসা উচিত হয়নি, বলল মেয়েমানুষটা। খুব বাজে জায়গা, বিপদ হতে পারে। সাঁতার কাটা কিংবা নৌকা-চড়া এটাতে নিষেধ।
তা-তো বলেনি আমাদেরকে! যেন খুব অবাক হয়েছে কিশোর। নিষিদ্ধ, তাও বলেনি। আপনারা ভুল খবর পেয়েছেন।
বাহ, কি সুন্দর একটা ডাহুক গো! হাত তালি দিয়ে নেচে উঠল রবিন। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে হ্রদের দিকে চেয়ে। কি ভাল জায়গা। কত জানোয়ার আর পাখি যে আছে।
বুনো ঘোড়াও নাকি অনেক, মুসা যোগ করল। গতকালই তো দেখলাম কয়েকটাকে। খুব সুন্দর ছিল, না?
দ্বিধায় পড়ে গেল দুই ডাকাত।
কড়া গলায় ধমক দিল ডারটি, চুপ! যত্তোসব! এখানে আসা নিষেধ, শুনছ? ঘাড়ে হাত পড়ার আগে কাটো।
নিষেধ? কণ্ঠস্বর হঠাৎ পাল্টে ফেলল কিশোর, কঠিন হয়ে উঠেছে চেহারা। তাহলে আপনারা এখানে কি করছেন? আর, ভদ্রভাবে কথা বলুন।
তবে রে আমার ভদ্রলোক! চেঁচিয়ে উঠল ডারটি, গেছে মেজাজ খারাপ হয়ে। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে আগে বাড়ল।
রাফিয়ানের বেল্ট ছেড়ে দিল জিনা।
সামনে এগোল কুকুরটা। ভয়ানক হয়ে উঠেছে চেহারা, ঘাড়ের নোম খাড়া। চাপা ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে গলার গভীরে।
চমকে গেল ডারটি। পিছিয়ে গেল আবার। ধরো, কুত্তাটাকে ধরো! হারামী জানোয়ার!
হারামী লোকের জন্যে হারামী জানোয়ারই দরকার, শান্ত কণ্ঠে বলল জিনা। তুমি যেমন কুকুর, ও-ও তেমন মুগুর। তোমরা যতক্ষণ কাছে-পিঠে থাকছ, ওকে ছেড়ে রাখব।
চাপা গর্জন করে আরও দুই কদম এগোল রাফিয়ান। চোখে আগুন।
চেঁচিয়ে উঠল মেয়েলোকটা, হয়েছে হয়েছে, রাখো। এই মেয়ে, তোমার কুত্তাটা ধরো। আমার এই বন্ধু না…ওর মেজাজ ভাল না।
আমার এই বন্ধুটিরও মেজাজ খারাপ, রাফিয়ানকে দেখাল জিনা। তোমাদের সইতে পারছে না। ঘাড়ে কামড় দিতে চায়। কতক্ষণ আছ তোমরা?
সেটা তোমাকে বলব কেন? গর্জে উঠল ডারটি।
তার গর্জনের জবাবে দ্বিগুণ জোরে গর্জে উঠল রাফিয়ান। আরেক পা পিছিয়ে গেল ডারটি।
চলো, খিদে পেয়েছে, সঙ্গীদের বলল কিশোর। এদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমরা যেমন অন্যের জায়গায় এসেছি, ওরাও এসেছে।
সহজ ভঙ্গিতে হাটতে শুরু করল অভিযাত্রীরা। দুই পা এগিয়ে ফিরে চেয়ে সঁতমুখ খিচিয়ে আরেকবার শাসাল রাফিয়ান, তারপর চলল বন্ধুদের সঙ্গে।
দুই ডাকাতের চোখে তীব্র ঘৃণা, কিন্তু বিশাল কুকুরটার ভয়ে কিছু করতে পারল, দৃষ্টির আগুনে ছেলেদের ভস্ম করার চেষ্টা চালাল শুধু।
ওদেরকে আরও রাগিয়ে দেয়ার জন্যে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল জিনা, রাফি, খেয়াল রাখবি। ব্যাটাটাকে ধরবি আগে।
পোড়া বাড়িটায় পৌঁছল ওরা। বলতে হলো না, রান্না ঘরের দরজায় পাহারায় বসল রাফিয়ান। দুই ডাকাতের দিকে ফিরে মুখ ভেঙচাল একবার, বুঝিয়ে দিল, কাছে এলে ভাল হবে না।
ভাঁড়ারে ঢুকল অন্যেরা। যেটা যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনিই আছে, কেউ
হাত দেয়নি।
ঢোকেইনি হয়তো এখনও, বলল কিশোর। দেখেনি। যতটা ভেবেছি, তার চেয়েও বাজে লোক ওই দুটো, টিকসি আর ডারটি।
হ্যাঁ, একমত হলো মুসা, জঘন্য। মেয়েমানুষটা বেশি খারাপ। চেহারাটাও জানি কেমন রুক্ষ।
আমার কাছে ডারটিকেই বেশি খারাপ লেগেছে, রবিন বলল। আস্ত একটা গরিলা। চুল কাটে না কেন?
কি জানি, একটা রুটির মোড়ক খুলতে শুরু করল জিনা। হয়তো ভাবছে সিনেমায় চান্স-টান্স পাবে। টারজানের বিকৃত সংস্করণ।
রাফি না থাকলে কিন্তু বিপদে পড়তাম, বলল রবিন। ও-ই ঠেকিয়েছে ব্যাটাদের।
কি করছে ব্যাটারা, দেখে আসা দরকার, প্রায় অর্ধেকটা পাউরুটি আর এক খাবলা মাখন তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল মুসা।
আধ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে। রুটি আর মাখন শেষ। ব্যাটাকে দেখলাম বোটহাউসের দিকে যাচ্ছে। ওয়াটার মেয়ারকে খুঁজতে বোধহয়।
হুঁ, খেতে খেতে বলল কিশোর। ব্যাপারটা নিয়ে আরও ভালমত ভাবতে হবে। কি করবে ওরা এখন? জানা আমাদের জন্যে খুব জরুরী। হয়তো মেসেজের পাঠোদ্ধার করে ফেলেছে ওরা, কঠিন শব্দ ব্যবহার শুরু করল সে। ওদের ওপর চোখ রাখতে হবে। দুর্বল মুহূর্তে কিছু ফাঁস করে দিতে পারে আমাদের কাছে।
মেসেজের সঙ্গে যে নকশাটা দিয়েছে জেরি, নিশ্চয় তার কোন মানে আছে, আপনমনে বলে যাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছে ডারটি আর টিকসি। রুটি চিবাতে চিবাতে ভাবনার অতলে তলিয়ে গেল সে। দীর্ঘ নীরবতার পর ভেসে উঠল আবার। আজ বিকেলেই কিছু একটা করতে হবে আমাদের। ভেলাটা ভাসিয়ে বেরিয়ে পড়ব হদে। যে কোন ছেলেমেয়েই তা করতে পারে, এতে কিছু সন্দেহ করবে না দুই ডাকাত। নৌকাটা খুঁজব আমরা। আর যদি হদে বেরোয় টিকসি আর ডারটি, একই সঙ্গে ওদের ওপরও চোখ রাখতে পারব।