নৌকাও একটা আছে অবশ্য, কিছু ভাবছে কিশোর। ইচ্ছে করলে ওটাতেও চড়া যায়।
আচ্ছা, তিনটে নৌকাই খুঁজে দেখলে হয় না? প্রস্তাব দিল মুসা। লুটের মাল আছে কিনা?
দরকার নেই, বলল কিশোর। তাহলে জলঘোটকীর নাম থাকত না মেসেজে। তোমার সন্দেহ থাকলে গিয়ে খুঁজে দেখতে পারো।
কিশোর পাশা যখন বলছে নেই, থাকবে না।
এক কাজ করো, আবার বলল কিশোর। সন্দেহ যখন হয়েছে, গিয়ে খুঁজে দেখো। এসব ব্যাপারে হেলাফেলা করা উচিত নয়। শিওর হয়েই যাই।
কিন্তু ওয়াটার মেয়ার গেল কোথায়? বলল সে। পরিবারের সবাই এখানে হাজির, আরেকটা গিয়ে লুকাল কোথায়? হ্রদের তীরে কোথাও লুকানো হয়েছে?
হ্যাঁ, তা হতে পারে, ভেলাটা ঠেলছে কিশোর, থেমে গেল। ডাঙায় না হোক, পাড়ের নিচে কোথাও কোন গলিঘুপচিতে লুকিয়ে রেখেছে হয়তো।
চলো না তাহলে, এখনি খুঁজে দেখি, ভেলায় চড়ার লোভ আপাতত চাপা দিল জিনা।
দেয়ালের ভাঙা ফোকর দিয়ে আবার বাইরে বেরোল ওরা। বুক ভরে টেনে নিল তাজা বাতাস। বোটহাউসের দুর্গন্ধ থেকে দূরে আসতে পেরে হাঁপ ছেড়েছে। সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে রাফিয়ান। অন্ধকার ওই ঘরটা মোটেও ভাল লাগছিল
তার। এই তো, কি চমৎকার উষ্ণ রোদ, কি আরামের বাতাস, লেজের রোম কি সুন্দর ফুলিয়ে দেয় ফুঁ দিয়ে।
কোনদিক থেকে শুরু করব? বলল রবিন। ডান, না বাম?
নীরবে পানির ধারে এগিয়ে গেল কিশোর, পেছনে অন্যেরা। ডানেও তাকাল, বায়েও। কিন্তু কোন দিকেই কোন পার্থক্য নেই, দু-দিকেই সমান ঘন ঝোপঝাড়।
পানির কাছাকাছি থাকাই মুশকিল, বলল কিশোর। দেখা যাক তবু। চলো, বাঁ দিক থেকেই শুরু করি।
শুরুতে জঙ্গল তেমন ঘন নয়, পানির কাছাকাছি থাকা গেল। পানির ওপর ঝুঁকে রয়েছে লতানো ঝোপ, যে কোনটার তলায় লুকিয়ে রাখা যায় নৌকা। উঁকি দিয়ে, পাড়ের নিচে নেমে, যতভাবে সম্ভব, নৌকা আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল ওরা।
সিকি মাইল পর থেকেই ঘন হতে শুরু করল জঙ্গল। এত ঘন যে পথ করে এগোনোই কঠিন, থাক তো পানির ধারে গিয়ে উঁকি দেয়া। পানির ধারে মাটি রসাল বলেই বোধহয়, জঙ্গল ওখানে আরও বেশি ঘন।
নাহ্, এভাবে হবে না, এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল কিশোর। যা কাঁটা। শেষে চামড়া নিয়ে ফিরতে পারব না।
হ্যাঁ, কাঁটা বেশিই, দুই হাতের তালু দেখছে মুসা, কেটে ছড়ে গেছে, কোন আঁচড়, এত গভীর, রক্ত বেরোচ্ছে। ঠিকই বলেছ, এভাবে হবে না।
অন্য দুজনেরও একই অভিমত। আনন্দ পাচ্ছে শুধু রাফিয়ান। বার বার উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে বনের দিকে। বুঝতে পারছে না যেন, এত সুন্দর কাটা আর ঝোপকে কেন পছন্দ করছে না বোকা ছেলে-মেয়েগুলো?
ছেলেরা যখন ফিরল, রীতিমত আহত বোধ করল রাফিয়ান। হতাশ ভঙ্গিতে হেঁটে চলল ওদের পেছনে।
ডানে চেষ্টা করে দেখব নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
নাহ্ লাভ হবে না,মাথা নাড়ল কিশোর। ওদিকে আরও বেশি জঙ্গল। খামোকা সময় নষ্ট। তার চেয়ে এক কাজ করি এসো?…ভেলায় চড়ে ঘুরি?
ঠিক বলেছ। দারুণ হবে, সঙ্গে সঙ্গে বলল জিনা। কষ্টও হবে না, তাছাড়া পানির দিক থেকে দেখার সুবিধে অনেক। কোন ঘুপচিই চোখ এড়াবে না। সহজেই খুঁজতে পারব।
ইস্, আগে মনে পড়ল না কেন? আফসোস করল মুসা। তাহলে তো এভাবে হাত-পাগুলো ছুলতে হত না।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আবার বোটহাউসের দিকে রওনা হলো ওরা।
হঠাৎ থেমে গেল রাফিয়ান। চাপা গর্জন করে উঠল।
কি হয়েছে, রাফি? থেমে গিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল জিনা।
আবার গোঁ গোঁ করে উঠল রাফিয়ান।
সাবধানে পিছিয়ে গেল চারজনে। একটা ঝোপের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাকাল বোটহাউসের দিকে। কই, কিছুই তো নেই? এমন করছে কেন তাহলে রাফিয়ান?
সবার আগে দেখল মুসা। কিশোরের পাঁজরে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল।
এক তরুণী, আর একটা লোক। কথা বলছে।
নিশ্চয় টিকসি, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
আর ওই ব্যাটা ডারটি রবিন, মুসা বলল, আমি শিওর।
১০
ওই দুজন আসবে, জানাই আছে ছেলেদের, তাই চমকাল না।
।ডারটিকে চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি মুসার। রাতে দেখেছে, সকালেও দেখেছে—চওড়া কাঁধ, সোজা হয়ে দাঁড়ালে সামান্য কুঁজো মনে হয়, মাথায় ঝাকড়া চুল। তবে, তার বাড়িতে তাকে যেমন লেগেছিল, এখন ঠিক ততটা ভীষণ মনে হচ্ছে না।
তবে মেয়েমানুষটাকে কেউই পছন্দ করতে পারছে না, একটুও না। পরনে ডোরাকাটা প্যান্ট, গায়ে রঙিন শার্টের ওপর আঁটসাট জ্যাকেট, চোখে বেমানান রকমের বড় সানগ্লাস, দাঁতের ফাঁকে চুরুট। ওর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, তীক্ষ্ণ স্বর।
ও-বেটিই তাহলে টিকসি, ভাবল কিশোর। জেরি ডাকাতকে দেখিনি, তবে ভালই সঙ্গিনী জুটিয়েছে ডাকাতটা।
সঙ্গীদের দিকে ফিরল গোয়েন্দাপ্রধান। রাফিয়ানের গলার বেল্ট টেনে ধরে রেখেছে জিনা, বেরোতে দিচ্ছে না। শোনো, কিশোর বলল, ওদেরকে না চেনার ভান করবে। কথা বলতে বলতে বেরোব আমরা, যেন জঙ্গল দেখতে ঢুকেছিলাম। যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবে বেড়াতে এসেছি। উল্টো-পাল্টা যা খুশি বলবে। বোঝাব, আমরা মাথামোটা একদল ছেলে-মেয়ে, স্রেফ ছুটি কাটাতে এসেছি। আর বেকায়দ কোন প্রশ্ন যদি করে, চুপ করে থাকবে, আমি জবাব দেব। ও-কে?
মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই।
ঝোপের ভেতর থেকে বেরোল কিশোর হুড়মুড় করে। ডাকল, মুসা, এসো। ওই যে, বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। মাই গড়, সকালের চেয়েও খারাপ দেখাচ্ছে এখন।