বোটহাউসটা কোথায়? আনমনে বলল মুসা। আছে না নেই, তাই বা কে জানে।
হ্রদের ধারের পথ ধরে দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করছে ওরা, পারছে না। নানা রকম বাধা। লতা, ঝোপঝাড় যেন একেবারে পানির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠে এসেছে ডাঙায়। বোটহাউস চোখে পড়ছে না।
এক জায়গায় হ্রদ থেকে একটা খাল বেরিয়ে ঢুকে গেছে জঙ্গলেন মধ্যে।
মানুষের কাটা খাল, বলল, কিশোর। নিশ্চয় বোটহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
খালের পাড় ধরে এগোল ওরা। খানিক পরেই চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, ওই যে! লাতাপাতায় এমন ঢেকে গেছে, বোঝাই যায় না। হাত তুলে দেখাল সে।
দেখল সবাই। সরু হতে হতে এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে খাল। ঠিক সেখানে খালের ওপর নেমে গেছে সরু লম্বা একটা বাড়ি। লতাপাতা ঝোপঝাড়ে এমন ঢেকে ফেলেছে, ভালমত না দেখলে ঠাহরই করা যায় না, ওখানে কোন বাড়িঘর আছে।
মনে হয় ওটাই, খুশি হয়ে উঠেছে মুসা। ওয়াটার মেয়ারকে পেলে হয় এখন।
বৈঁচি আর এক জাতের কাঁটা-গাছই বেশি। ওগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে এগোতে গিয়ে কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শরীর, কিন্তু উত্তেজনায় খেয়ালই করছে না ওরা।
বাড়ির সামনেটা পানির দিকে, ওটাই সদর। একটা চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে পানির ধার থেকে।
ওখান দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু পা রাখতেই ভেঙে পড়ল পচা তক্তা। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। না, হবে না এদিক দিয়ে। অন্য পথ খুঁজতে হবে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর কোন পথ পাওয়া গেল না।
পুরো বাড়িটাই কাঠ দিয়ে তৈরি। শেওলা জমে রয়েছে সবখানে। এক জায়গায় দেয়ালের তক্তা পচে কালো হয়ে গেছে।
লাথি মারল মুসা। জুতোশুদ্ধ পা ঢুকে গেল পচা কাঠে।
চারজনে মিলে সহজেই দেয়ালের তক্তা ভেঙে বড় একটা ফোকর করে ফেলল। আগে ঢুকল কিশোর। অন্ধকার। বাতাসে কাঠ আর পচা লতাপাতার ভেজা দুর্গন্ধ।
চওড়া সিঁড়িটার মাথায় এসে দাঁড়াল সে। নিচে কালো অন্ধকার পানি, একটা ঢেউও নেই। ফিরে ডাকল, এসো, দেখে যাও।
সিঁড়ির মাথায় এসে নিচে তাকাল সবাই। আবছা অন্ধকার। নৌকা রাখার ছাউনি এটা-বোটহাউস। পানির দিকে মুখ, কিন্তু এখন পুরোপুরি ভোলা নেই। আগাছা আর লতা অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। ছাত থেকে ঝুলছে লতা, নিচের পানির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে জলজ আগাছা, এরই ফাঁক দিয়ে যতখানি আলো আসতে পারছে, আসছে। তবে অন্ধকার তাতে কাটছে না বিশেষ।
চোখে সয়ে এল আবছা অন্ধকার। দেখতে পাচ্ছে এখন।
ওই যে নৌকা! নিচের দিকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
খুঁটিতে বাঁধা। ওই তো, আমাদের ঠিক নিচেই একটা।
মোট তিনটে নৌকা। দুটো অর্ধেক ডুবে রয়েছে পানিতে, দুটোরই গলুই পানির নিচে।
তলা ফুটো হয়ে গেছে বোধহয়, ঝুঁকে নিচে চেয়ে আছে কিশোর। কোমরের বেল্ট থেকে টর্চ খুলে নিয়ে জ্বালল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আলো ফেলে দেখল বোটহাউসের ভেতরে।
দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো দাঁড়। কতগুলো কালচে থকথকে নরম জিনিস রয়েছে কয়েকটা তাকে, পাটাতনে ফেলে বসার গদি, পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এক কোণে একটা নোঙর পড়ে আছে। দড়ির বাণ্ডিল সাজানো রয়েছে একটা তাকে। বিষণ্ণ পরিবেশ। কথা বললেই বিচ্ছিরি প্রতিধ্বনি উঠছে।
পরিত্যক্ত বোটহাউস ভূতের বাসা—মনে পড়ে গেল মুসার। ভয়ে ভয়ে তাকাল চারদিকে। সে-ও টর্চ খুলে নিল। আলো জ্বেলে ভূত তাড়ানোর ইচ্ছে। নিচু গলায় বলল, ওয়াটার মেয়ার কোনটা?
ওই যে, একটা নৌকার গলুইয়ের কাছে আলো ফেলে বলল কিশোর, ওয়াটার কি যেন? কয়েক ধাপ নামল সে। ও, ওয়াটার লিলি।
আরেকটা নৌকার গলুইয়ের কাছে আলো ফেলল মুসা।
অকটোপাস, বলে উঠল রবিন।
বাহুঁ, চমৎকার, বলল মুসা। একটার নাম ওয়াটার লিলি, আরেকটা একেবারে অকটোপাস। মালিকের মাথায় দোষ ছিল।
আর ওই যে, ওটার কি নাম? তৃতীয় নৌকাটা দেখাল জিন। ওটাই ওয়াটার মেয়ার?
দুটো টর্চের আলো এক সঙ্গে পড়ল নৌকাটার গলুইয়ের কাছে। শুধু এম অক্ষরটা পড়া যাচ্ছে। সাবধানে আরও নিচে নামল কিশোর। তক্তা ভেঙে পানিতে পড়ার ভয় আছে। রুমাল ভিজিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করল নামের জায়গাটা।
হুঁ, বিড়বিড় করল কিশোর, অকটোপাস, লিটল মারমেইড, ওয়াটার লিলি…অকটোপাস, জলকুমারী, জলপদ্ম শিওর, জলঘোটকীও, এই পরিবারেরই মেয়ে…
অকটোপাসটা ছেলে, না? বলল মুসা।
কি জানি, হাত ওল্টাল কিশোর। ওটার মালিকই জানে।
কিন্তু ওয়াটার মেয়ারটা কোথায়? জিনার প্রশ্ন।
পানিতে ওদিকে কোথাও ডুবে আছে? বোটহাউসের মুখের দিকে দেখাল মুসা।
মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর। দেখছ না, পানি কম? ডুবে থাকলেও দেখা যেত। তলার বালি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
তবু, আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আলো ফেলে দেখল পানির যতখানি চোখে পড়ে। আর কোন নৌকা নেই এখানে।
গেল কোথায় জলঘোটকী, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। কখন? কিভাবে? কেন?
বোটহাউসের ভেতরটা আরেকবার ভালমত দেখল ওরা। সিঁড়ির কাছে, বোটহাউসের এক পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে কাঠের বড় একটা জিনিস।
কি ওটা? জিনা বলল। ওহহো, ভেলা।
কাছে গিয়ে ভেলাটা ভাল করে দেখল সবাই।
বেশ ভাল অবস্থায়ই আছে, ভেলার গায়ে হাত বোলাল কিশোর। ইচ্ছে করলে আমরা পাঁচজনেই চড়তে পারব এটাতে।
দারুণ মজা হবে, আনন্দে হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল জিনা। ভেলায় চড়তে যা ভাল্লাগে না আমার। নৌকার চেয়েও মজার।