জেল-পালানো বন্ধুর কাছে মেসেজ দিয়ে দেবে, বলল রবিন, অন্য দুই সহকারীকে জানানোর জন্যে, চোরাই মাল কোথায় আছে। পুলিশ আসার আগেই ওগুলো বের করে নিয়ে চম্পট দেবে ওরা।
ঠিক তাই, মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
তাহলে ডাকাতদের আগে আমরা খুঁজে বের করব মালগুলো, জ্বলজ্বল করছে। জিনার চোখ। কাল ভোরে উঠেই খোঁজা শুরু করব।
হুঁ, তাহলে মেসেজের কোড বুঝতে হবে আগে, বলল মুসা। টু-ট্রীজ আর ব্ল্যাক ওয়াটার তো বুঝলাম। কিন্তু ওয়াটার মেয়ার?
জলঘোটকী, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
কি বললে?
আঁ…জলঘোটকী, মানে পানির ঘোড়া। বোট…এই কোন নৌকা বা লঞ্চ।
ঠিক বলেছ, তর্জনী দিয়ে জোরে বাতাস কোপাল জিনা। যে জন্যে হ্রদ, সে জন্যে নৌকা। গোসলই যদি না করল, সাঁতার না কাটল আর নৌকা নিয়ে মাছ। ধরতে না গেল, তাহলে এতবড় হ্রদের ধারে কেন বাড়ি করতে যাবে লোকে? নিশ্চয় একটা বোট আছে কোথাও, তাতে চোরাই মাল লুকিয়েছে ব্যাটারা।
কিন্তু অতি সহজে রহস্য ভেদ হয়ে গেল না? সন্দেহ যাচ্ছে না রবিনের। একটা বোটে চোরাই মাল লুকাবে…যে কেউ দেখে ফেলতে পারে বোটটা… তাছাড়া, মেসেজ লেখা কাগজটায় আঁকিবুকিগুলো কিসের?
মুসা, হাত বাড়াল কিশোর, নকশাটা দেখি?
পকেট থেকে চার টুকরো ছেড়া কাগজ বের করে দিল মুসা।
হাসি মুখে ব্যাগ খুলে এক রোল টেপ বের করে দিল জিনা। নাও, কাজে লেগেই গেল। মনে হয়েছিল লাগতে পারে, তাই নিয়েছিলাম।
কাজের কাজ করেছ একটা, কিশোরও হাসল।
টেপ দিয়ে জুড়ে চার টুকরো কাগজ আবার এক করে ফেলা হলো।
এই যে দেখো, নকশায় আঙুল রাখল কিশোর, এখানে চারটে লাইন মিশেছে। প্রত্যেকটা লাইনের শেষ মাথায় লেখা…এত অস্পষ্ট করে লিখেছে… নুয়ে ভালমত দেখে একটা পড়ল সে, টক হিল।…এটা, স্টীপল…
আর এটা চিমনী, রবিন পড়ল তৃতীয় শব্দটা।
আর এটা হলো টল স্টোন, চতুর্থটা পড়ল জিনা।
দিল মাথা গরম করে, হাত ওল্টাল মুসা। বলি, মানে কি এগুলোর?
কিছু তো একটা নিশ্চয়, বলল কিশোর। শব্দগুলো মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
সকাল নাগাদ পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।
৯
নকশাটা সাবধানে ভাঁজ করে নিজের কাছে রেখে দিল কিশোর।
আরেকটা অংশ কিন্তু আছে টিকসির কাছে, মনে করিয়ে দিল মুসা। সেটা ছাড়া সমাধান হবে?
হতেও পারে, বলল কিশোর। হয়তো তার কাছেও এটারই আরেক কপি পাঠানো হয়েছে।
তাহলে তো সেও খুঁজতে আসবে এখানে, বলল জিনা। এলে আসবে, মুসা বলল। লুকিয়ে থাকব।
তারও দরকার নেই, মাথা নাড়ল কিশোর। আমাদের কাছে নকশা আছে জানছে কি করে? দেখে ফেললে বলব, ছুটিতে বেড়াতে এসেছি।
তারপর চোখ রাখব তার ওপর, হাসল রবিন। বেটি অস্বস্তি বোধ করবে?
করলে করুক, আমাদের কি… কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেল মুসা, কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে।
গম্ভীর হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, টিকসি একা আসবে বলে মনে হয় না। হয়তো ডারটিকে নিয়েই আসবে। ডারটির কাছে মেসেজ নেই তো কি হয়েছে? টিকসির কাছে আছে। একই মেসেজ হলে ওই একটাতেই চলবে। ডারটি যদি ওদের সহকারী হয়, কিছুঁতেই তাকে ফেলে আসবে না টিকসি।
হ্যাঁ, তাই তো, মাথা দোলাল রবিন। আর ডারটি মেসেজ পায়নি শুনলে সন্দেহ জাগবে। হুঁশিয়ার হয়ে যাবে।
তার মানে যতটা সহজ মনে হয়েছিল, হাই তুলতে তুলতে বলল রবিন, তত সহজ নয় ব্যাপারটা…এহ্, বড্ড ঘুম পেয়েছে। যাই, শুয়ে পড়ি।
মুসাও হাই তুলল। আমিও যাই।
যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ল মুসা আর রবিন। ওদের কাছ থেকে দূরে ঘরের এক কোণে বিছানা পাতল জিনা। শুয়ে পড়ল। তার পায়ের কাছে রাফিয়ান।
একটা রেখে বাকি মোমগুলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল কিশোরও।
দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল চারজনেই।
লম্বা হয়ে শুয়ে আছে রাফিয়ান, চোখ বন্ধ, কিন্তু কান খাড়া। সামান্যতম শব্দ হলেই নড়েচড়ে উঠছে।
একবার মৃদু একটা শব্দ হতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। নাক উঁচু করে বাতাস শুকল, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ির কাছে। একটা ফাটলে নাক নিয়ে গিয়ে কল, পরক্ষণেই শান্ত হয়ে ফিরে এল আগের জায়গায়। সাধারণ একটা ব্যাঙ।
মাঝরাতের দিকে আবার মাথা তুলল সে। ওপরে রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে উঠে এল ওপরে। চাদের আলোয় পান্নার মত জ্বলে উঠল তার সবুজ চোখ।
দ্রুত চলে যাচ্ছে একটা জানোয়ার। রোমশ মোটা লেজ। শেয়াল। কুকুরের গন্ধ পেয়েই পালাচ্ছে।
সিঁড়ির মুখে অনেকক্ষণ বসে বসে পাহারা দিল রাফিয়ান। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল আবার।
গলে গলে শেষ হয়ে গেছে মোমটা। ঘর অন্ধকার। অঘোরে ঘুমোচ্ছে সবাই। জিনার পায়ের কাছে এসে আবার শুয়ে পড়ল সে।
সবার আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের। শক্ত মেঝেতে শুয়ে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে। চোখ মেলে প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় আছে, আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। সবাইকে ডেকে তুলল সে।
তাড়াহুড়ো করে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নিল সবাই। অনেক কাজ পড়ে আছে।
হ্রদের দিকে চলে গেছে একটা সরু পথ। দুই ধারে নিচু দেয়াল ছিল এক সময়, এখন ধসে পড়েছে। শেওলায় ঢেকে গেছে ইট। পথ ঢেকে দিয়েছে লতার জঙ্গল, মাঝে মাঝে ছোট ঝোপঝাড়ও আছে। পথের অতি সামান্যই চোখে পড়ে।
তেমনি নিথর হয়ে আছে কালো হ্রদটা। তবে তাতে, প্রাণের সাড়া দেখা যাচ্ছে এখন। ওদের দেখে কঁক করে পানিতে ডুব দিল একটা জলমুরগী।