ওই গাছগুলোর জন্যেই নিশ্চয় নাম রেখেছে টু-ট্রীজ, বলল সে। এতটা নির্জন হবে, ভাবিনি।
নির্জন কি বলছ? বলে উঠল মুসা। রীতিমত ভূতুড়ে। গা ছমছম করে।
সূর্য ডোবার অপেক্ষায়ই যেন ছিল কনকনে ঠাণ্ডা। ফিসফিসিয়ে কানাকানি করে গেল এক ঝলক বাতাস, হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে গেল অভিযাত্রীদের।
এসো, জরুরী কণ্ঠে বলল কিশোর, রাত কাটানোর জায়গা খোঁজা দরকার।
বিষণ্ণ বাড়িটায় নীরবে ঢুকল ওরা। দোতলার কিছুই অবশিষ্ট নেই। নিচতলার অবস্থাও শোচনীয়। তবে এক কোণে শোয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কালো ছাইতে মাখামাখি আধপোড়া একটা কার্পেট এখনও বিছানো রয়েছে মেঝেতে, বিরাট একটা টেবিলও আছে।
বৃষ্টি এলে ওটাতে উঠে বসতে পারব, টেবিলটা দেখিয়ে বলল কিশোর। তবে দরকার হবে বলে মনে হয় না।
একেবারেই বাজে জায়গা, রবিনও মুখ বাঁকাল। গন্ধ! থাকা যাবে না এখানে।
অন্য জায়গা খোঁজা দরকার, কিশোর বলল। অন্ধকারও হয়ে এসেছে। আগে লাকড়ি নিয়ে আসি, আগুনের ব্যবস্থা করে, তারপর…
জিনাকে রেখে লাকড়ি আনতে বেরোল অন্য তিনজন। শুকনো ডালের অভাব নেই। তিন আঁটি লাকড়ি নিয়ে ফিরে এল ওরা।
জিনা বসে থাকেনি। থাকার জন্যে আরেকটা জায়গা খুঁজে বের করে ফেলেছে, প্রথমটার চেয়ে ভাল।
ছেলেদের দেখাতে নিয়ে চলল সে। রান্নাঘরের এক ধারে মেঝেতে একটা দরজা, পাল্লা তুলে রেখেছে জিনা, নিচে ধাপে ধাপে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে।
ভাড়ারে গিয়েছে, সিঁড়ি দেখিয়ে বলল জিনা। ঢুকেছিলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, অনুমান। নিচে নিশ্চয় আগুন ঢুকতে পারেনি, ছাই থাকবে না। ওপরের ঘরের চেয়ে ওখানে ভাল হবে। থাকতে পারব।
টর্চ জেলে নামতে শুরু করল কিশোর, পেছনে অন্যেরা। রাফিয়ান চলেছে তার পাশে পাশে।
কয়েক সিঁড়ি বাকি থাকতেই এক লাফে গিয়ে মেঝেতে নামল কুকুরটা। ওপরেরটার চেয়ে অনেক ভাল ঘর। বিদ্যুতের তার, বোর্ড, সকেট, সুইচ সবই লাগানো আছে। জেনারেটর ছিল, বোঝাই যায়।
ছোট ঘর। মেঝেতে পোকায় খাওয়া কার্পেট। ঘুণে ধরা আসবাবপত্রে ধুলোর পুরু আস্তরণ। ভাড়ার-কাম-বসার ঘর ছিল এটা। সারাঘরে মাকড়সার জাল, গালে লাগতেই থাবা দিয়ে সরাল জিনা।
তাকে কিছু মোমবাতি পাওয়া গেল। ভালই হলো। অন্ধকারে থাকতে হবে।
লাকড়ি এনে ঘরের কোণে জড়ো করে রাখা হলো।
আসবাবগুলো কোন কাজের নয়। ঘুণে খেয়ে একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে। একটা চেয়ারে গিয়ে বসেছিল মুসা, মড়মড় করে ভেঙে পড়ল ওটা। হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে চিতপটাং হলো গোয়েন্দা-সহকারী। হেসে উঠল সবাই।
তবে টেবিলটা মোটামুটি ঠিকই আছে। ধুলো পরিষ্কার করে ওটার ওপর রাখা হলো খাবারের প্যাকেট।
বাইরে অন্ধকার। চাঁদ ওঠেনি। শরতের শুকনো পাতায় মর্মর তুলে ঘুরেফিরে বইছে বাতাস, কিন্তু কালো হ্রদটা আগের মতই নিথর। ছলছলাৎ করে তীরে আছড়ে পড়ছে না ঢেউ।
ভাঁড়ারে আলমারিও আছে একটা। খুলে দেখল কিশোর। আরও মোমবাতি, বাহ, চমত্তার। প্লেট…কাপ…এই, কুয়া-টুয়া চোখে পড়েছে কারও?খাবার পানি লাগবে।
না, কুয়া দেখেনি কেউ। তবে রবিন একটা জিনিস দেখেছে, ওপরে রান্নাঘরের এক কোণে, সিংকের কাছে। বোধহয় পাম্প, বলল সে। চলো দেখি, ঠিক আছে কিনা।
মোমবাতি জ্বেলে ওপরে উঠে এল সবাই। ঠিকই বলেছে রবিন। পাম্প-ই। ট্যাংকে পানি তোলা হত হয়তো। বড় সিংকের ওপরে কলও আছে, ট্যাংক থেকেই পানি আসত।
হাতল ধরে ঠেলে জোরে জোরে পাম্প করল রবিন। কলের মুখ দিয়ে তোড়ে বেরিয়ে এল পানি, ভিজিয়ে দিল বহুদিনের শুকনো সিংক।
রবিনকে সরিয়ে হাতল ধরল মুসা। পাম্প করে চলল। অনেক বছর পর আবার পানি উঠছে ট্যাংকে। ধুলো-ময়লা আর মরচে মিশে কালচে-লাল হয়ে কলের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে পানি। ধুয়ে পরিষ্কার হতে সময় লাগবে।
একনাগাড়ে পাম্প করে চলেছে মুসা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে পানি।
একটা কাপ ধুয়ে পানি নিল তাতে কিশোর। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি, লালচে, রঙ রয়েছে সামান্য, তবে সেটা কেটে গেলে স্ফটিকের মত হয়ে যাবে। চুমুক দিয়ে দেখল। আহ, দারুণ। এক্কেবারে যেন ফ্রিজের পানি।
থাকার চমৎকার জায়গা পাওয়া গেছে, খাবার পানি মিলেছে, আর খাবার তো সঙ্গে করে নিয়েই এসেছে। মোমবাতি আর লাকড়ি আছে প্রচুর। আর কি চাই? বিছানা পেতে আরাম করে জাঁকিয়ে বসল ওরা।
খিদে পেয়েছে কারও? জিজ্ঞেস করল কিশোর। এই মুসা, খাবে?
আমারই পেয়েছে, আর ওর পাবে না? হেসে বলল জিনা।
কিছু রুটি, মাখন আর এক টিন গোশত খুলে নিয়ে বসল ওরা। খেতে খেতেই আলাপ-আলোচনা চলল, আগামীদিন কি কি করবে।
কি খুঁজছি আসলে আমরা? জানতে চাইল রবিন। কিছু লুকানো-টুকানো আছে ভাবছ?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। কি আছে, তা-ও বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি।
কী? একই সঙ্গে প্রশ্ন করল তিনজন।
ধরি, দলের নেতা জেরি। সে রয়েছে জেলে। তার যে বন্ধু পালিয়েছিল, তার কাছে একটা মেসেজ দিয়েছে অন্য দুই বন্ধু বা সহকারীকে দেয়ার জন্যে। সেই দুজনের একজন হলো ডারটি রবিন, অন্যজন টিকসি।
ধরা যাক, বেশ বড় ধরনের একটা ডাকাতি করেছে জেরি, একে একে তিনজনের মুখের দিকে তাকাল কিশোর, আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এসেছে ওরা। রাফিয়ানও যেন গভীর আগ্রহে শুনছে, এমনি ভাবসাব, জিনার গা ঘেঁষে রয়েছে। কি ডাকাতি করেছে, জানি না, তবে সম্ভবত গহনা। টাকাও হতে পারে। সেগুলো লুকিয়ে রেখেছে কোথাও। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে এলে তারপর বের করবে। যে কারণেই হোক, ডাকাতির পর পরই ধরা পড়ে কয়েক বছরের জন্যে জেলে গেছে সে। ডাকাতির মাল কোথায় রেখেছে, কিছুঁতেই বলেনি পুলিশকে। কিন্তু পুলিশ ছাড়বে কেন? যেভাবেই হোক, কয়েদীর মুখ থেকে কথা আদায় করবেই। সেটা বুঝতে পেরেছে জেরি। কি করবে সেক্ষেত্রে?