তবে একটা সুখবর দিয়েছে, রবিন বলল। কয়েদী ধরা পড়েছে। ডাকাতটা ছাড়া থাকলে বনেবাদাড়ে ঘুরে শান্তি পেতাম না, মন খচখচ করতই।
ভাবতে হবে, কিশোর বলল। তবে আগে খাবার ব্যবস্থা করা দরকার। এখানে অনেক ফার্মহাউস আছে, দেখা যায়।
গ্রামরক্ষীর বাড়ির কাছ থেকে সরে এল ওরা। ছোট একটা মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করল, এমন কোন ফার্মহাউস আছে কিনা, যেখানে খাবার কেনা যায়।
ওই তো, পাহাড়ের মাথায় একটা, হাত তুলে দেখাল মেয়েটা। আমার দাদুর বাড়ি। দাদী খুব ভাল, গিয়ে চাইলেই পাবে।
থ্যাংকস, বলল কিশোর।
ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে পথ। বাড়ির কাছাকাছি হতেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে পিঠের রোম খাড়া হয়ে গেল রাফিয়ানের, চাপা গোঁ গোঁ করে উঠল।
চুপ, রাফি, মাথায় আলতো চাপড় দিল জিনা। খাবারের জন্যে এসেছি এখানে। ওদের সঙ্গে গোলমাল করবি না।
বুঝল রাফিয়ান। রোম স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার, গোঁ গো বন্ধ। রেগে ওঠা কুকুরদুটোর দিকে বন্ধু সুলভ চাহনি দিয়ে তার ফোলা লেজটা ঢুকিয়ে নিল দুই পায়ের ফাঁকে।
এই, কি চাও? ডেকে জিজ্ঞেস করল একজন লোক।
খাবার, চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর। ছোট একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বলল এখানে পাওয়া যাবে।
দাঁড়াও, মাকে জিজ্ঞেস করি, বলে বাড়ির দিকে চেয়ে ডাকল লোকটা, মা? মা?
সাংঘাতিক মোটা এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, চঞ্চল চোখ, আপেলের মত টুকটুকে গাল।
খাবার চায়, ছেলেদের দেখিয়ে বলল লোকটা।
এসো, ডাকলেন মহিলা। এই চুপ, চুপ, নিজেদের কুকুরগুলোকে ধমক দিলেন।
দেখতে দেখতে কুকুরদুটোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলল রাফিয়ান। ছোটাছুটি খেলা শুরু করল।
বেশ ভাল খাবার। পেট ভরে খেলো অভিযাত্রীরা। রাফিয়ান তো এত বেশি গিলেছে, নড়তে পারছে না, খালি হাঁসফাঁস করছে।
ওরা খাবার টেবিলে থাকতেই সেই ছোট মেয়েটা এসে ঢুকল। হাই, হাসল সে। বলেছিলাম না, আমার দাদী খুব ভাল। আমি নিনা। তোমরা?
একে একে নাম বলল কিশোর। তারপর বলল, ছুটিতে ঘুরতে এসেছি। খুব চমৎকার কিন্তু তোমাদের অঞ্চলটা। কয়েক জায়গায় তো ঘুরলাম, বেশ ভাল লাগল। আচ্ছা, টু-ট্রীজটা কোথায় বলতে পারো?
মাথা নাড়ল মেয়েটা। আমি জানি না। দাঁড়াও, দাদীকে জিজ্ঞেস করি। দাদী? ও দাদী?
দরজায় উঁকি দিলেন মহিলা। কি?
টু-ট্রীজ? খুব সুন্দর জায়গা। এখন অবশ্য নষ্ট হয়ে গেছে। একটা হ্রদের ধারে, জংলা জায়গা। হ্রদটার নাম যে কি…কি…
ব্ল্যাক ওয়াটার? কিশোর বলল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্ল্যাক ওয়াটার। ওখানে যাচ্ছে নাকি? খুব সাবধান। আশেপাশে জঙ্গল, জলা…তো, আর কিছু লাগবে-টাগবে?
আরিব্বাপরে। আরও? না, না, হাসল কিশোর, পেট নিয়ে নড়তে পারছি।। খুব ভাল বেঁধেছেন। বিলটা যদি দেন। আমাদের এখন যেতে হবে।
বিল আনতে চলে গেলেন মহিলা।
নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা, কোথায় যেতে হবে? ব্ল্যাক ওয়াটার?
হ্যাঁ-না কিছুই বলল না কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে আনমনে বলল শুধু, কালোপানি।
৭
ফার্মহাউস থেকে বেরিয়ে বলল কিশোর, টু-ট্রীজ কতদূরে, সেটা আগে জানা দরকার। সম্ভব হলে আজই যাব, নইলে কাল। বেলা এখনও আছে।
কতদূরে সেটা, কি করে জানছি? বলল মুসা। ম্যাপ দেখে বোঝা যাবে?
যদি ম্যাপে থাকে। থাকার তো কথা, হ্রদ যখন।
উপত্যকায় নেমে এল আবার ওরা। রাস্তা থেকে দূরে নির্জন একটা জায়গা দেখে এসে বসল।
ম্যাপ বের করে বিছাল কিশোর। চারজনেই ঝুঁকে এল ওটার ওপর।
সবার আগে রবিনের চোখে পড়ল। ম্যাপের এক জায়গায় আঙুলের খোঁচা মেরে বলল, এই যে, ব্ল্যাক ওয়াটার। কিন্তু টু-ট্রীজ তো দেখছি না।
ধ্বংস হয়ে গেলে সেটা আর ম্যাপে দেখানো হয় না, যদি কোন বিশেষ জায়গা না হয়। যাক, ব্ল্যাক ওয়াটার তো পাওয়া গেল। তো, কি বলল, যাব আজ? কত দূরে, বুঝতে পারছি না।
এক কাজ করলে পারি, জিনা প্রস্তাব দিল। পোস্ট অফিসে খোঁজ নিলে পারি, ডাকপিয়নের কাছে। সব জায়গায়ই চিঠি বিলি করে, কোথায় কি আছে, সে-ই সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে।
সবাই একমত হলো।
সহজেই খুঁজে বের করা গেল পোস্ট অফিস। গাঁয়ের একটা দোকানের এক অংশে অফিস, দোকানদারই একাধারে পোস্টমাস্টার থেকে পোস্টম্যান। বৃদ্ধ এক লোক, নাকের চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন ছেলেদের দিকে।
ব্ল্যাক ওয়াটার? বললেন তিনি। ওখানে যেতে চাও কেন? সুন্দর জায়গা ছিল এককালে, কিন্তু এখন তো নষ্ট হয়ে গেছে।
কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পুড়ে গেছে। মালিক তখন ওখানে ছিল না, শুধু দুজন চাকর ছিল। এক রাতে হঠাৎ জ্বলে উঠল বাড়িটা, কেন, কেউ বলতে পারে না। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দমকল যেতে পারেনি, পথ নেই। কোনমতে ঘোড়ার ছোট গাড়ি-টাড়ি যায়।
আর ঠিক করা হয়নি, না?
না, মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। বাকি যা ছিল, ওভাবেই পড়ে থাকল। এখন ওটা দাঁড়কাক, পেঁচা আর বুনো জানোয়ারের আজ্ঞা। অদ্ভুত জায়গা, ভূতের আগুন নাকি দেখা যায়। গিয়েছিলাম একদিন দেখতে। আগুন দেখিনি, তবে হ্রদের কালো পানি দেখেছি। যে রেখেছে, একেবারে ঠিক নাম রেখেছে।
কদ্দূর? যেতে কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করল জিনা।
ওরকম একটা জায়গায় কেন যেতে চাও? হ্রদের পানিতে গোসল করতে? পারবে না, পারবে না, নামলে জমে যাবে। ভীষণ ঠাণ্ডা।