পানিতে পা রেখেই নরম ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল জিনা। খোলা নীল আকাশের দিকে তামাটে চোখ। হলুদ রোদে যেন জ্বলছে তামাটে চুল। খুব সুন্দর লাগছে তাকে।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার শুরু হলো চলা।
ডিয়াটোতে কখন পৌঁছবে জানে না। তবে তাড়াও নেই। সাঁঝের আগে কোন ফার্মহাউস খুঁজে পেলেই হলো। রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
থানা থাকলে সেটা খুঁজে বের করতে হবে আগে, বলল কিশোর। তারপর ফার্ম…
৬
ডিয়াটোতে থানা আছে। ছোট্ট থানা, একজন মাত্র গ্রামরক্ষী। আশপাশের চারটে গাঁয়ের দায়িত্বে রয়েছে সে, ফলে নিজেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট না ভাবলেও বেশ দামী লোক মনে করে। শেরিফ হলে কি করত কে জানে।
গ্রামরক্ষী সাহেবের বাড়িটাই থানা। আরামে বসে ডিনার খাচ্ছে, এই সময় এসে হানা দিল অভিযাত্রীরা। লোভনীয় সসেজ আর তাজা কাটা পেঁয়াজগুলোর দিকে তাকিয়ে উঠে এল বিরক্ত হয়ে।
কি চাই? কমবয়েসীদের দু-চোখে দেখতে পারে না লোকটা। তার মতে, সব ছেলেমেয়েই বিচ্ছু, গোলমাল পাকানোর ওস্তাদ। কিশোর-বয়েসীগুলো বেশি ইবলিস।
অদ্ভুত কতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সার, ভদ্রভাবে বলল কিশোর। ভাবলাম, শেরিফকে জানানো দরকার। আপনি কি শেরিফ?
অ্যাঁ?…হা…না না, কি বলবে বলো জলদি। গতরাতে একজন কয়েদী পালিয়েছিল।
মরেছে, বলে উঠল লোকটা, তুমিও দেখেছ বলতে এসেছ। কতজন যে এল, সবাই নাকি দেখেছে। একজন লোক একসঙ্গে এতগুলো জায়গায় যায় কি করে, ঈশ্বরই জানে।
আমি না, শান্ত রইল কিশোর, আমার এই বন্ধু। গতরাতে সত্যি দেখেছে। একটা মেসেজ নিয়ে এসেছিল লোকটা।
তাই নাকি? তরল কণ্ঠে বলল গ্রামরক্ষী। তোমার বন্ধু তাহলে আরেক কাটি বাড়া। শুধু দেখেইনি, মেসেজও পেয়েছে। তা মেসেজটা কি? স্বর্গে যাওয়ার ঠিকানা?।
অনেক কষ্টে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল মুসা, টু-ট্রীজ, ব্ল্যাক ওয়াটার, ওয়াটার মেয়ার, টিকসি নোজ।
বাহ, বেশ ভাল ছন্দ তো, ব্যঙ্গ করল গ্রামরক্ষী। টিকসিও জানে। তাহলে টিকসিকে গিয়ে বললো, কি কি জানে এসে বলে যেতে আমাকে। তোমাদের আরেক বন্ধু বুঝি?
না, তাকে চিনি না, অপমানিত বোধ করছে মুসা। কড়া জবাব এসে যাচ্ছিল মুখে, কোনমতে সামলাল। আমার জানার কথা নয়, যদি না লোকটা এসে বলত। ভাবলাম, বুঝতে পারে এমন কাউকে জানিয়ে যাই। এই যে, এই কাগজটা দিয়েছিল।
ছেড়া পাতাটা হাতে নিয়ে দুর্বোধ্য আঁকিবুকির দিকে চেয়ে বাঁকা হাসল গ্রামরক্ষী। আরে, আবার কাগজও দিয়েছে। কি লেখা?
আমি কি জানি? হাত ওল্টালো মুসা। আর সহ্য করতে পারছে না। সেজন্যেই তো আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। কয়েদী ধরতে সুবিধে হবে ভেবে।
কয়েদী ধরব? কুটিল হাসি ফুটল লোকটার মুখে। এত কিছু জানো, আর আসল কথাটা জানো না? কয়েদী ব্যাটা ধরা পড়েছে ঘন্টাচারেক আগে। ঘোড়ার গাড়ি চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিল। এতক্ষণে জেলে ঢোকানো হয়েছে আবার। কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল, হাসি হাসি ভাবটা উধাও হয়েছে চেহারা থেকে। আর শোনো, ছেলেছোকরাদের ভেঁপোমি আমি সইতে পারি না। আর কক্ষণো…
ভেঁপোমি করছি না, স্যার, কালো হয়ে গেছে কিশোরের মুখ। সত্যি-মিথ্যে বোঝার ক্ষমতা নেই, চোর ধরেন কি করে?
রাগে গোলাপী হয়ে গেল গ্রামরক্ষীর গাল। কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না। তার মুখের ওপর এভাবে আর কখনও বলেনি কেউ। দেখো খোকা…
আমি খোকা নই। বয়েস আরেকটু বেশি।
চড়ই মেরে বসবে যেন গ্রামরক্ষী, এত রেগে গেল।
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে লোকটার প্রায় নাকের নিচে ঠেলে দিল কিশোর, নিন, এটা পড়লেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
নিচের সই আর সীল দেখেই চেহারা অন্যরকম হয়ে গেল গ্রামরক্ষীর, সামলে নিল নিজেকে। কাগজটা নিয়ে পড়ল। লেখা আছে :
এই কার্ডের বাহক ভলানটিয়ার জুনিয়র, রকি বীচ পুলিশকে সহায়তা করছে। একে সাহায্য করা মানে পক্ষান্তরে পলিশকেই সাহায্য করা।
–ইয়ান ফ্লেচার
চীফ অভ পুলিশ
লস অ্যাঞ্জেলেস।
মুখ কালো করে কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল গ্রামরক্ষী, তা এখন কি করতে হবে আমাকে? রিপোর্ট লিখে নিতে হবে?
সেটা আপনার ইচ্ছে, ঝাল ঝাড়ল কিশোর।
ঠিক আছে, লিখে নিচ্ছি, পকেট থেকে নোটবই বের করল গ্রামরক্ষী, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও। তবে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, এটা তোমাদের রকি বীচ নয়। এখানকার চোর-ছ্যাচোড়রা অন্যরকম। গলাকাটা ডাকাত। ওদের সঙ্গে গোলমাল করতে গেলে বিপদে পড়বে।
সে-ভয়েই বুঝি কেঁচো হয়ে থাকো, ব্যাটা, বলার খুব ইচ্ছে হলো কিশোরের। বলল, সেটা দেখা যাবে। দিন, আমাদের কাগজটা দিন।
কয়েকজন কিশোরের কাছে হেরে গিয়ে মেজাজ খিচড়ে গেছে গ্রামরক্ষীর, কি ভাবল কে জানে, দুই টানে ফড়তি ফড়াত করে চার টুকরো করে ফেলল মেসেজটা, ফেলে দিল মাটিতে। বলল, রিপোর্ট লেখা দরকার, লিখে নিয়েছি। কিন্তু বাজে কাগজ হেঁড়ার জন্যে কচুটাও করতে পারবে না কেউ আমার, বলে নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে, গটমট করে চলে গেল ঘরের দিকে।
আস্ত ইতর! লোকটা শুনল কিনা, কেয়ারই করল না জিনা। এমন করল কেন?
লোকটাকেও দোষ দিতে পারি না, কাগজের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে মুসা, সেদিকে চেয়ে বলল কিশোর। যা একখান গল্প এসে বলেছি, বিশ্বাস করবে কি? ওর জায়গায় আমি হলেও করতে চাইতাম না। এদিকের গায়ের লোক এমনিতেই বানিয়ে কথা বলার ওস্তাদ।