সংক্ষেপে জানাল রবিন, পথ হারিয়ে কিভাবে গিয়ে উঠেছিল বাড়িটাতে।
বাধা না দিয়ে চুপচাপ শুনল কিশোর, তারপর বলল, ঘণ্টা শুনে ভয় পেয়েছে, নিশ্চয় মুসা ভূতের ভয় ঢুকিয়েছে তোমার মনে?
জোরে জোরে দুহাত নাড়ল মুসা, কি বোঝাতে চাইল সে-ই জানে। মুখ ভর্তি খাবার, কথা বলতে পারছে না।
অ, তোমরা তাহলে শোনননি কিসের ঘণ্টা, বলল কিশোর। পাগলা-ঘন্টি, মিসেস নরিস বলেছেন। জেল থেকে কয়েদী পালালে নাকি ওরকম বাজিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় গ্রামবাসীকে।
আর আমরা এদিকে কি ভয়ই না পেয়েছিলাম, মলিন হেসে মাথা নাড়ল রবিন।
নাস্তা শেষ হলো। এক টুকরো খাবারও পড়ে রইল না। উচ্ছিষ্টও না। যা ছিল, সাবাড় করে দিয়েছে রাফিয়ান।
কিছু স্যাণ্ডউইচ কিনে নেয়া দরকার, বলল কিশোর। দুপুরে খাওয়ার জন্যে।
হ্যাঁ, নাও, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা।
বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে কিশোর বলল, মুসা, রবিনের কথা তো বললে। তুমি গোলাঘরে কিভাবে রাত কাটালে বললে না তো।
এতক্ষণে মনে পড়ল মুসার, রবিনকেও বলা হয়নি রাতের কথা। বলার অবকাশও পায়নি অবশ্য। দুজনে তখন ইয়েলো পণ্ড খোঁজায় এত ব্যস্ত, পেটে খিদে, আলাপ করার মানসিকতাই ছিল না।
এক কাণ্ড হয়েছে কাল রাতে, বলল মুসা। ওটা সত্যি ভূতের বাড়ি।
তোমার কাছে তো সবই ভূত, হাত নাড়ল কিশোর। চলো, কোথাও বসে শুনি। মনে হচ্ছে, অনেক কিছু বলার আছে তোমার।
নির্জন একটা জায়গা দেখে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসল ওরা।
সব খুলে বলল মুসা। চুপ করে শুনল সবাই।
পকেট থেকে কাগজটা বের করে দিল মুসা। ওটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অন্যেরা। এমন কি রাফিয়ানও ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিল, যেন মহা-পণ্ডিত।
আগামাথা কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। কিশোর। তবে নকশা-টকশা কিছু হবে। কিসের কে জানে।
ব্যাটা বলল, জানাল মুসা, টিকসির কাছে নাকি বাকি অর্ধেক আছে।
এই টিকসিটা কে? বলল জিনা। আল্লাহ মালুম।
রবিনের নামই বা জানল কিভাবে? এই কিশোর, কি ভাবছ? কনুই দিয়ে কিশোরের পাজরে তো দিল জিনা।
বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়ল কিশোর।
আমি পারছি, দু-আঙুলে চুটকি বাজাল হঠাৎ রবিন।
জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল কিশোর।
মুসা, ছেলেটা কি বলেছিল? বলল রবিন। বলেছিল বুড়ির ছেলের নাম ডারটি রবিন রেখেছে লোকে। গতরাতে আমাকে নয়, ওকেই ডেকেছিল বুলেট-মাথা। বুড়ির ছেলে গোলাঘরে তার জন্যেই অপেক্ষা করেছে। জানে না, আগেই এসে তোমাকে ডারটি ভেবে মেসেজ দিয়ে চলে গেছে লোকটা।
ঠিক বলেছ, একমত হলো মুসা।
আনমনে বলল শুধু কিশোর, হুঁ। জেল পালানো কয়েদীর সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই তো? প্রশ্ন রাখল জিনা।
অসম্ভব না, বলল কিশোর। হতেও পারে। মেসেজটা সে-ই দিয়ে গেছে। হয়তো। কিন্তু কার কাছ থেকে আনল?
জেরি? মুসা বলল।
জেরি, না? হতে পারে। হয়তো সে এখন জেলে আছে, তার বন্ধু বুলেটমাথা, পালিয়েছে। বন্ধুর কাছেই মেসেজটা দিয়েছে সে। তাহলে ডারটি রবিন ওদেরই দলের কেউ। কোন বদ-মতলব আছে ব্যাটাদের।
কি মতলব?
তা জানি না। তবে হতে পারে, পাগলাঘন্টি শুনেই ডারটি বুঝেছে, যে তার বন্ধু পালিয়েছে। মেসেজ নিয়ে আসবে তার কাছে। তাই গোলাঘরে এসে বসেছিল মেসেজের আশায়।
হ্যাঁ, তাই হবে, মাথা দোলাল মুসা।
অথচ ভুলে মেসেজটা পড়ল এসে তোমার হাতে, রবিন বলল। মুসা, ভূতই মনে হয় গতরাতে আমাদেরকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল ওখানে, কোন একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে…
ধ্যাত, সব বাজে কথা, হাত নেড়ে মাছি তাড়াল যেন জিনা। চলো, গিয়ে পুলিশকে জানাই। কয়েদী ধরতে সুবিধে হবে তাদের।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ছুটিতে এসেছি আনন্দ করতে, ডাকাত-টাকাতের খপ্পরে পড়তে চাই না। ম্যাপ বের করে নীরবে দেখল মিনিটখানেক। এই থানা-টানা থাকলে এখানেই থাকবে।
উঠল ওরা। খুশি হলো রাফিয়ান। নাস্তার পর পরই এত সময় ধরে বসে থাকাটা মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না তার। লাফাতে লাফাতে আগে আগে চলল সে।
পা তো একেবারে ভাল, ছুটিটা মাঠে মারা যায়নি বলে রবিনও খুশি। ভালই হয়েছে, শিক্ষা হয়েছে একটা। বোকার মত আর খরগোশের গর্তে ঢুকবে না।
হ্যাঁ, সত্যই শিক্ষা হয়েছে রাফিয়ানের। আর গর্তে ঢুকল না। তবে পরের আধ ঘন্টায় অন্তত ডজনখানেক বার মুখ ঢোকাল খরগোশের গর্তে। ধরা তো দূরের কথা, ছুঁতেও পারল না কোনটাকে। ওর চেয়ে খরগোশের পাল অনেক বেশি তাড়।
খোলা মাঠে বুনো ঘোড়া চরছে।
একবার একটা পাহাড়ী পথে মোড় নিতেই মুখোমুখি হয়ে গেল একপাল বুনো ঘোড়ার। অবাক চোখ মেলে অভিযাত্রীদের দেখল। তারপর একই সঙ্গে ঘুরে খুরের খটাখট তুলে দ্রুত হারিয়ে গেল পাহাড়ের ঢালের বনে। পিছু নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠল রাফিয়ান, জোর করে তার গলার বেল্ট টেনে ধরে রাখল জিনা।
খুব সুন্দর, না? বলল সে। আদর করতে ইচ্ছে করে।
গতদিনের মতই সকালটা সুন্দর, রোদে উজ্জল। পায়ের তলায় সবুজ ঘাস। একটা ঝর্নার পাড় দিয়ে হাঁটছে এখন। মৃদু ঝিরঝির করে বইছে টলটলে পানি, যেন গান গেয়ে নেচে নেচে ছুটে চলেছে মাতোয়ারা হয়ে।
দুপুরের দিকে জুতো খুলে ঝর্নায় পা ডুবিয়ে বসল ওরা। পায়ে হালকা পালকের মত পরশ বোলাচ্ছে পানি।
স্যাণ্ডউইচ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে পেট পুরে খেলে ঝর্নার পানি।