এবার আর বাইরে নয়, কিশোরের নির্দেশে গেটের ভেতরে গাড়ি ঢোকাল হ্যানসন, গাড়িপথ ধরে এগোল।
সরু পথ, এতবড় গাড়ির উপযুক্ত নয়। দুপাশের ঝোপঝাড়ের পাতা, লতার ডগা আর পামের পাতা ঘষা খাচ্ছে গাড়ির গায়ে।
অবশেষে পুরানো বাড়ির গাড়িবারান্দায় এসে থামল গাড়ি, খানিকক্ষণ আগে এখানেই আরেকবার এসেছিল দুই গোয়েন্দা।
মুসা, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর, যে গাড়িটা বেরিয়ে গেল, ওটার বিশেষ কিছু চোখে পড়েছে?
টু-ডোর, স্পোর্টস মডেল রেঞ্জার, খুব ভাল ইংলিশ কার, বলল মুসা। নতুন ক্যালিফোর্নিয়ার নাম্বার, পুরোটা বলতে পারব না, তবে শেষ দুটো নাম্বার ওয়ান থ্রী।
হ্যানসন, আপনি দেখেছেন নম্বরটা?
না। গাড়ি চালানোয় ব্যস্ত ছিলাম। নজর পথের ওপর। তবে রেঞ্জার ঠিকই। লাল চামড়ার গদি।
যাক, কিছু তথ্য জানা থাকল, বলল কিশোর। পরে মোটা লোকটা আর তার গাড়ি খুঁজে বের করব। দরজা খুলে নামল সে। এখন দেখি মিস্টার ফোর্ডের কি অবস্থা।
কিশোরকে অনুসরণ করল মুসা। বুঝতে পারছে না, কিভাবে পরে লোকটা আর তার গাড়ি খুঁজে বের করবে গোয়েন্দাপ্রধান, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার লাখ লাখ গাড়ির ভেতর থেকে।
তবে বলেছে যখন, উপায় একটা করবেই কিশোর, তাতে কোন সন্দেহ নেই মুসার।
হঠাৎ থমকে গেল ওরা। বিষণ্ণ বাড়িটা থেকে আবার শোনা গেল সাহায্যের আবেদন, বাঁচাও!…শুনছ কেউ?…প্লীজ, আমাকে ছাড়াও…
জোর নেই তেমন গলায়। মারা যাচ্ছে নাকি? তাড়াতাড়ি বলল মূসা, চলো তো, দেখি।
পেছন দিক থেকে এসেছে আওয়াজ, ওদিকে ছুটল দুই গোয়েন্দা। একটা দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, ওখান দিয়েই বোধহয় বেরিয়ে গেছে মোটা লোকটা, তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি ভালমত লাগল কি-না।
ঢুকে পড়ল দুজনে। আবছা অন্ধকার। মিটমিট করে চোখে সইয়ে নিল স্বল্প আলো।
কান পেতে শুনছে। নীরব। কোথায় যেন পুরানো তক্তায় চাপ লাগার মৃদু খচখচ,আওয়াজ হলো।
ওই যে, ওই হলটায় ঢুকেছিলাম তখন, হাত তুলে দেখাল কিশোর। চলো, উল্টো দিকের ঘরটায় ঢুকি। ওই যে দরজা।
ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। বড় একটা লিভিং রুম। ঘুলঘুলি লাগানো মস্ত জানালা আছে একটা।
কে…কে ওখানে? দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠল কেউ জানালাটার কাছ থেকে। জানালার নিচে বিশাল এক ফুলের টব, লাল একটা ফুল ফুটে আছে। মুসার মনে হলো, ফুলটাই যেন কথা বলেছে।
কেউ…কেউ এসেছ? গুঙিয়ে উঠল যেন ফুলটা।
টবের ছড়ানো পাতার ওপাশে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল মুসার। বড় বড় পাতাগুলো প্রায় ঢেকে রেখেছে শরীরটা।
ওই যে, চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
কাত হয়ে পড়ে আছে রোগা পাতলা একটা দেহ, হাত-পা বাঁধা।
বাঁধন খুলে মিস্টার ফোর্ডকে ধরে ধরে এনে একটা সোফায় বসিয়ে দিল মূসা আর কিশোর। ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়লেন তিনি। ফিসফিস করে ধন্যবাদ দিলেন ছেলেদের।
একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল কিশোর। পুলিশকে খবর দিচ্ছি।
না না,আঁতকে উঠলেন ফোর্ড। ফোনও নেই। খবর দেয়া যাবে না। আমাদের গাড়িতে ওয়্যারলেস টেলিফোন আছে।
না, গড়িয়ে পড়লেন তিনি, কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে তাকালেন কিশোরের দিকে। তুমি কে? এখানে এলে কিভাবে?
একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর। মিস্টার ক্রিস্টোফার তাদেরকে পাঠিয়েছে, জানাল।
ডেভিসের কাছে আমি ঋণী হয়ে গেলাম।
সত্যি বলছেন পুলিশ ডাকব না? আপনাকে জোর করে বেঁধে ফেলে রেখে গেল, এটা অপরাধ
না। তোমরা গোয়েন্দা, তোমরাই আমার কাকাতুয়াটাকে খুঁজে দাও। পুলিশকে আর ডাকছি না আমি। জানিয়েছিলাম ওদের। প্রথমে বলল, হয়তো উড়ে চলে গেছে। আমি চাপাচাপি করায় শেষে বলল, পাবলিসিটির জন্যে নাকি আমি
এমন করছি।
হুঁ, বুঝলাম। এখন ডাকলে আবার বলবে, পাবলিসিটির নতুন ফন্দি করেছেন।
হ্যাঁ, বুঝেছ। তাহলে কোন পুলিশ নয়, কথা দাও?
কথা দিল কিশোর, পুলিশকে কিছু বলবে না। হারানো কাকাতুয়ার ব্যাপারে সব খুলে বলার অনুরোধ জানাল।
বিলিকে খুব ভালবেসে ফেলেছি, বললেন ফোর্ড। ওর পুরো নাম বিলি শেকসপীয়ার। উইলিয়াম শেকসপীয়ার কে ছিলেন, নিশ্চয় জানো।
জানি। দুনিয়ার সেরা নাট্যকারদের একজন। পনেরোশো চৌষট্টি সালে ইংল্যাণ্ডে জন্মেছিলেন, মারা গেছেন যোলোমশা মোল সালে। তার নাটকগুলো এখনও মঞ্চস্থ হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বেশি জনপ্রিয় নাটকটা বোধহয় হ্যামলেট।
বহুবার অভিনয় করেছি আমি হ্যামলেটে, উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন ফোর্ড। দর্শকরা বলত, খুব ভাল অভিনয় করি। সোজা হয়ে বসে এক হাত রাখলেন বুকে, আরেক হাত সোজা করে নাটকীয় ভঙ্গিতে ভরাট গলায় বললেন, টু বি, অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দা কোয়েশচেন। ছেলেদের দিকে ফিরে বললেন, হ্যামলেটের একটা ডায়লগ। সম্ভবত শেকসপীয়ারের লেখার সবচেয়ে পরিচিত লাইন। আমার কাকাতুয়াটাও শিখেছিল, বার বার আউড়াতো।
শেকসপীয়ারের ডায়লগ বলত? মুসা বলল। খুব শিক্ষিত পাখি তো।
তা বলতে পারো। কথায় ব্রিটিশ টান ছিল। একটা মাত্র জন্মদোষ ছিল পাখিটার।
জন্মদোষ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ, তোতলামি। সে বলত : টু-টু-টু বি অর নট টু-টু-টু বি, দ্যাট ইজ দা কোয়েশচেন।
আগ্রহে উজ্জল হলো কিশোরের চোখ। শুনলে, মুসা? কাকাতুয়া তোতলায়, এই প্রথম শুনলাম। বোঝা যাচ্ছে, দারুণ একখান কেস পেয়েছি।