পাথর সরিয়েই চলেছে ডিংকি।
জন সিলভারের কয়েকটা মেসেজ বুঝেছি তাড়াতাড়িই, আবার বলল শোঁপা। তবে এই কবরখানার কথা ভাবিনি প্রথমে। তাড়াহুড়ো ছিল। ম্যাপ-ট্যাপ নিয়ে বসতে পারলে অবশ্য বুঝে যেতাম। শেষে টুরিস্ট ব্যুরোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, আশেপাশে নির্জন পোড়ো জায়গা কোথায় কোথায় রয়েছে। মেরিটা ভ্যালির কথা ওরাই জানাল।
টমের পায়ে এসে পড়ল মাঝারি সাইজের একটা পাথর। গাল দিয়ে উঠল সে। ধমক দিয়ে বলল, এই, দেখে ফেলতে পারো না?
দেখেই ফেলো, ডিংকি, নরম গলায় বলল শোঁপা। পাথর হাড্ডিতে পড়লে ব্যথা লাগে।
বড় চ্যাপ্টামত একটা পাথর সরিয়েই অস্ফুট শব্দ করে উঠল ডিংকি। টেনে পাথরের তলা থেকে বের করে আনল জিনিসটা। এই যে নিন, মিস্টার শোঁপা, আপনার বাক্স।
বাহ! এগিয়ে গিয়ে বাক্সটা নিল শোঁপা। পাশে চোদ্দ ইঞ্চি, লম্বায় তার প্রায় দ্বিগুণ। ছোট শক্ত একটা তালা লাগানো রয়েছে কড়ায়। হ্যাঁ, সাইজ ঠিকই আছে। ভেরি গুড, ডিংকি।
ওটাই, বাংলায় বলল কিশোর, বিষণ্ণ কণ্ঠ।
মুসা বুঝল। কিশোরের কাছে বাংলা মোটামুটি শিখে নিয়েছে সে আর রবিন।
পকেট থেকে খুব শক্তিশালী ঘোট একজোড়া কাটার বের করল শেপী, এক চাপেই কট করে কেটে ফেলল ধাতব আঙটা।
বাজে অবস্থা, কুয়াশার দিকে চেয়ে বলল শোঁপা। তবে মনে হয় না ছবিটার কোন ক্ষতি হবে। ভাল ছবি ভাল রঙ দিয়েই আঁকা হয়। এক পলক দেখি, নিজেকেই বোঝাচ্ছে সে, আসলে লোভ সামলাতে পারছে না।
সাবধানে ডালা তুলে ভেতরে চেয়েই চেঁচিয়ে উঠল রাগে। লাফ দিয়ে তার, পাশে এসে দাঁড়াল ডিংকি। ছেলেদের দিকে মনোযোগ হারিয়েছে টমাসও, গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাক্সের ভেতর কি আছে।
এক টুকরো কাগজ রয়েছে শুধু বাক্সের ভেতরে। বের করে জোরে জোরে পড়ল শোঁপা, সরি, বন্ধু, মেসেজের মানে ঠিকমত বোঝনি।
কিশোর, ফিসফিস করে বাংলায় বলল মুসা, এই-ই সুযোগ, বলেই ঝাড়া মারল। বাক্সের ভেতর কি আছে দেখার জন্যে ঢিল দিয়েছিল টমাস, ঢিলই রয়ে গেছে আঙুল, ফলে ছুটিয়ে নিতে পারল মুসা। একই সঙ্গে ডাইভ দিয়ে পড়ল সামনে। ছো মেরে তুলে নিল পায়ের কাছে পড়ে থাকা পুরানো পাইপটা। গুলি করবে কিনা দ্বিধা করছে টমাস, সুযোগটা কাজে লাগাল মুসা। এক বাড়ি দিয়ে ফেলে দিল পিস্তল। পরক্ষণেই গায়ের জোরে বাড়ি মারল টমাসের মাথা সই করে।
চট করে সরিয়ে নিয়ে মাথা কোনমতে বাঁচাতে পারল টমাস, কিন্তু কাঁধ বাঁচাতে পারল না। আঁউউ করে উঠে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়ল। দাঁড়িয়েই আছে কিশোর। এসব বিশেষ মুহূর্তে তার পেশী যেন জড় হয়ে যায়, নড়তে চায় না। এক হাতে পাইপ, আরেক হাতে কিশোরের কজি চেপে ধরে টান মারল মুসা। দৌড়ে গিয়ে ঢুকে গেল ঘন কুয়াশার মধ্যে। সামনে খানিকটা জায়গায় কুয়াশা যেন জট বেঁধে কালো হয়ে গেছে, আসলে ইউক্যালিপটাসের একটা ঝাড়। কিশোরকে নিয়ে ছুটে ওটার ভেতরে ঢুকে পড়ল মুসা।
ট্রাকটা ওদিকে, ফিসফিস করে বলল মুসা, হাত তুলে একটা দিক দেখাল। কিছুই চোখে পড়ল না কিশোরের। কোনটা যে কোন দিক, মুসা কি করে খেয়াল রেখেছে, সে-ই জানে। কিশোরের কাছে সব দিক একই রকম লাগছে।
কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বুঝেছি, শুধু বলল মুসা।
বিশ্বাস করল কিশোর। দিকচিহ্ন খুঁজে বের করার ব্যাপারে ওস্তাদ তার সহকারী। রাতের বেলায়ও এমন সব জায়গায় পথ খুঁজে বের করে ফেলে মুসা, কিশোর যেখানে দিনেই হারিয়ে যায়।
শোননা, দ্রুত বলল মুসা, দেয়ালের ধার ধরে যাও, মাঝে মাঝেই ইউক্যালিপটাসের ঝাড় পাবে। আমরা যেখান দিয়ে ঢুকেছিলাম সেই ফাঁকটার কাছে চলে যেতে পারবে। ঝড়ের ভেতরে ভেতরে চলে যাও!
পারব না, অনিশ্চিত শোনাল গোয়েন্দাপ্রধানের কণ্ঠ, হারিয়ে যাব।
হারাবে না…ওই যে, ব্যাটারা আসছে, ওদের ভুল পথে তুলে দিয়ে আসিগে। গাছের দিকে চোখ রাখবে। আশ্চর্যবোধক আর তীর চিহ্ন এঁকে এঁকে যাব। অসুবিধে হবে না তোমার। যাও।
কাঁধ চেপে ধরে ঝটকা দিয়ে বন্ধুকে ঘুরিয়ে সামনে ঠেলে দিল মুসা। তারপর আরেক দিকে ঘুরে লোকগুলোকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল, এই কিশোর, এই যে এদিকে, এসো।
হই-চই শোনা গেল তিনজন মানুষের।
আবার শোনা গেল মুসার কথা। সরে যাচ্ছে। দূর থেকে দূরে লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে চলল সে।
অন্ধের মত ছুটছে কিশোর। ভাঙা কুশ, শুভ আর পাথরে হোঁচট খেলো, হুমড়ি খেয়ে পড়ল কয়েকবার। কনুই আর হাঁটুর চামড়া ছিলল কয়েক জায়গায়। এক ঝাড় থেকে বেরিয়ে অনেক কষ্টে খুঁজে পেল আরেকটা ঝাড়।
কুয়াশা এখানে সামান্য হালকা, যেন পানির নিচে রয়েছে সে। কয়েক ফুটের বেশি নজর চলে না। কুয়াশা আসছে…আসছেই ঢেউয়ের মত একনাগাড়ে। গাঢ় হচ্ছে ধূসর রঙ। ওপর দিকে কুয়াশা অনেক পাতলা, তার মধ্যে দিয়ে কোণাকুণি দৃষ্টি চলে অনেক দূর। প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে একটা গাছের মাথা আবছামত দেখতে পেল কিশোর। দৌড় দিল সেদিকে।
তিন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তিনজন মানুষের কণ্ঠস্বর, পথ হারিয়েছে মনে হচ্ছে।
মুসার কোন সাড়াশব্দ নেই, কোথায় রয়েছে বোঝা যাচ্ছে না।
গাছের কাছে এসে থামল কিশোর। কুয়াশা এখানে খুবই পাতলা। গাছের গায়ে নীল চকে আঁকা আশ্চর্যবোধকটা স্পষ্ট। তীর চিহ্ন বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে।