এক জায়গায় চল্লিশ ফুট দূরের দেয়ালের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে চলে গেছে একটা পথ, ওটা ধরেই এগোচ্ছে এখন।
একশো গুণে থামল মুসা। এবার?
পাঁচ নম্বর বলছে, ইউ নো মাই মেথডস, ওয়াটসন। থ্রি সেভেনস লীড টু থারটিন।
মাথা লিখেছে, রাগ করে বলল মুসা।
চিন্তিত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিশোর। হঠাৎ বলল, মুসা, তোমার কদম কি পুরো এক গজ?
কি জানি। মেপে তে দেখিনি।
তাহলে মেপে দেখা যাক। পকেট থেকে একটা প্লাসটিকের টুকরো বের করল কিশোর, একটা তিন বছরের পকেট ক্যালেণ্ডার। এক ধারে চার ইঞ্চি লম্বা স্কেল রয়েছে। মুসার ছড়ানো কদম মেপে দেখল। হুমম। তিরিশ ইঞ্চি। একশো কদমে কম হয়েছে পঞ্চাশ ফুট। হাঁটো। আরও বিশ কদম।
একেবারে পেছনের দেয়ালের কাছে চলে এল ওরা। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত পাথর বা কোন কিছু নেই।
দেখো, হাত তুলে উল্টোদিকে খানিক দূরের তিনটে পাথরের ফলক দেখাল মুসা। পাশাপাশি তিনটে কবরের মাথার কাছে গাথা। তিনটে ফলকে তিনটে নাম হিউগো সেভার্ন, পিটার সেভার্ন, মরিস সেভার্ন। ১৮৮৮ সালের একটা তারিখ লেখা রয়েছে নিচে, একই দিনে তিনজনে পীতজুরে মারা গেছে।
সেভার্ন। চেঁচিয়ে উঠল মুসা, সেদিনই ধরেছিলাম। রবিন উড়িয়ে দিল ইংরেজদের কথার টনি বলে। খ্রি সেভার্নস লীড টু থারটিন।
হ্যাঁ, সেভার্নরা রয়েছে এখানে। কিন্তু তেরোর কাছে নিয়ে যাবে কিভাবে? দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল কিশোর।
পাথরগুলো রয়েছে এক সারিতে, বুদ্ধি খুলে যাচ্ছে মুসার, এক লাইন। লাইনটা ধরে ডানে-বাঁয়ে যে কোন একদিকে হাঁটি।…ইয়াল্লা, কিশোর, জলদি, করো। কুয়াশা এসে পড়ছে।
পাক খেয়ে খেয়ে এগিয়ে আসছে হালকা কুয়াশা, এটা সামনের স্তর, ঘিরে ধরল দুই গোয়েন্দাকে। হাহাকার করে গেল বাতাস, যেন অশরীরী কোন প্রেতের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। শিউরে উঠল মুসা। ককিয়ে বলল, কিশোর, জলদি করো, প্লীজ!
বিষণ্ণ পরিবেশকে আরও বিষণ্ণ করে তুলছে বিচ্ছিরি কুয়াশা, কিন্তু কিশোরের ভাবান্তর নেই। গালে টোকা দিচ্ছে, তাকাচ্ছে আশেপাশে। হুঁ!, লাইনটা গিয়ে শেষ হয়েছে ওই পাথরটায়। চলো তো দেখি।
আরেকটা প্রস্তরফলক। এপাশে কিছুই লেখা নেই। ঘুরে ওপাশে আসতেই দেখতে পেল ওরা, লেখা রয়েছে :
চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে এখানে
তেরোজন অচেনা ভ্রমণকারী
ইণ্ডিয়ানরা খুন করেছে এদের সবাইকে।
জুন ১৭, ১৮৭৬
থারটিন! ফিসফিস করল মুসা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে, যেন ঘুম ভেঙে যাবে তেরোজন হতভাগ্য মানুষের। তিন সেভার্ন নিয়ে এল তেরোর কাছে।
ছয় নম্বর বলছে, কিশোর বলল, লুক আনডার দা স্টোনস বিয়ণ্ড দা বোনস ফর দা বক্স দ্যাট হ্যাজ নো লকস।
কিন্তু কোন পাথরটা? এখানে তো পাথরে বোঝাই।
মেসেজ বলছে, বিয়ণ্ডা দা বোনস, বাঁকা চোখে কয়েকটা পাথরের দিকে তাকাল কিশোর। দূর, কুয়াশা এসেই পড়ল দেখি।…ওই যে, দেয়ালের ধারের ওই মনুমেন্টের কাছে, পাথর পড়ে আছে কতগুলো…কোনকালে পড়েছিল কে জানে, ঠিক করেনি আর।…আচ্ছা, তেরোজনের হাড়গোড়কে বোনস ধরে নিলে ওগুলোকেই স্টোনস বোঝায়, আশেপাশে আর যা আছে, একটা করে পাথর, সুপ নেই…।
কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটে গেল মুসা। দু-হাতে পাথর সরাতে শুরু করল। মুখ না তুলে বলল, কিশোর, হাত লাগাও। কুয়াশার আগেই শেষ করতে হবে।
কাজে এতই মগ্ন রয়েছে ওরা, পেছনে পদশব্দ শুনতে পেল না।
বাহ, খুব কাজের ছেলে, বলে উঠল কেউ।
কানের কাছে যেন বাজ পড়েছে, এত জোরে চমকে উঠল দুজনে।
ঘনায়মান কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে তিনটে মূর্তি, একজন শোঁপা, কোন সন্দেহ নেই, পাশের দুজনকেও চেনে, একজনের নাম জানে, টমাস, আরেকজনের জানে না।
তোমাদের কাজ শেষ, কাছে এসে হাসল শোঁপা। আর কষ্টের দরকার নেই। এবার আমরাই পারব। টমাস, ধরো ওদের।
মনে মনে, এক সঙ্গে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল দুই গোয়েন্দা। লাফিয়ে উঠে দুজন ছুটল দুদিকে। কিন্তু পারল না। ধরা পড়ে গেল।
টমাস, তুমি ধরে রাখো, আদেশ দিল শোঁপা। ডিংকি, পাথর সরাও।
মুসার হাত মুচড়ে ধরল টমাস, পিস্তল বের করে পিঠে ঠেকাল। কিশোরকে বলল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নাকি বন্ধুর পিঠ ফুটো করাতে চাও?
১৬
ঠাণ্ডা, ভেজা গুড় দিয়ে ওদেরকে পেঁচিয়ে নিচ্ছে যেন ঘন কুয়াশা।
দ্রুত হাত চালাচ্ছে ডিংকি, লুকানো হাড় খুঁজছে যেন ক্ষুধার্ত কুকুর। ছোটবড় পাথর, টালি আর কাঁচা ইটের টুকরো ছুঁড়ে ফেলছে চারপাশে, একটা ভাঙা ডাল ছুঁড়ে ফেলল, একটা পুরানো পাইপ ফেলল, কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা টমাস আর ছেলেদের গায়েও এসে পড়ছে কিছু।
এই, দেখেটেখে ফেলো, বলল টমাস। লাগে।
হ্যাঁ, এত তাড়াহুড়ো কি? বলল শোঁপা। আরও আস্তে সরাও না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে দুই গোয়েন্দা। তেতো হয়ে গেছে মন। এত কষ্টের পর লাভটা কি হলো? ওরা ছবি বের করে দিল, মজা লুটবে এখন ওই বিদেশী চোর।
মন খারাপ লাগছে? শান্তকণ্ঠে বলল শোঁপা। জানো, দুনিয়ার অনেক জায়গায় গিয়েছি আমি, অনেক মিউজিয়ম থেকে ছবি চুরি করেছি, অনেক উঁদরেল পুলিশ আর গার্ডকে বোকা বানিয়ে এসেছি, নিজেকে খুব চালাক ভাবতাম। কিন্তু না বলে পারছি না, তোমরা আমার মত লোককেও বহুত নাকানি-চুবানি খাইয়েছ। ওই গাড়ি বদলানোর বুদ্ধিটা তো রীতিমত…কি বলব? হতবাক করে দিয়েছে আমাকে। কুয়াশায় ভিজে নিভে যাওয়া সিগারেট আবার ধরিয়ে নিয়ে হাসল। কুয়াশার মধ্যে জ্বলন্ত লাইটার হাতে কালো আলখেল্লা পরা মূর্তিটাকে ঠিক মানুষ মনে হচ্ছে না এখন, কবর থেকে উঠে এসেছে যেন, ভূত। আন্দাজ ঠিকই করেছিলে তোমরা, তোমাদের ওপর চোখ রাখতে বলেছিলাম। রেখেছিলও। রোলস-রয়েসটাকে অনুসরণ করেছিল। বিশ মিনিট পর ওটার পাশ কাটিয়ে আসার সময় দেখল ভেতরে মাত্র একটা ছেলে। ফোনে জানাল আমাকে। প্রথমে বুঝতেই পারিনি, ঘটনাটা কি ঘটেছে। অনেক ভাবার পর..নাহ, ইয়াং ম্যান, তোমরা প্রতিভাবান। আমার ভক্তি এসে গেছে। আমি চোর, ঠিক, কিন্তু এনথনি শোঁপার শ্রদ্ধা পেতে হলে… জোরে জোরে কয়েকবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে, কিন্তু কুয়াশার জন্যে দেখা গেল না ধোঁয়া, এক রঙ হয়ে গেছে।