আমার সঙ্গে যাবে তোমরা, যেখানে নিয়ে যাব, আবার বলল হাইমাস। একটু গোলমাল করেছ কি… কথাটা শেষ করল না সে। ইয়া বড় এক ছুরি বের করল। পাতলা ঝকঝকে বাঁকা ফলা, হাতলের কাছটায় একটা সাপের ছবি খোদাই করা।
এটার নাম সর্প-ছুরি, ভীষণ ভঙ্গিতে ছুরিটা নাড়ল সে। হাজার বছর আগে দামেসকে তৈরি হয়েছিল। এটার একটা বাজে ইতিহাস আছে। বারোজন লোককে খুন করেছে ইতিমধ্যেই। আরও এক বা দুজনকে খুন করতে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। তেরো নম্বর কে হতে চাও? আনলাকি থারটিন?
৯
দ্রুত ছুটছে ভ্যান। হলিউডের পরে খাড়া রুক্ষ পাহাড়শ্রেণী ছাড়িয়ে এল।
আগেই সতর্ক করেছি তোমাদের, এক সময় বলল মহিলা। শোনোনি।
এইবার মনে পড়ল রবিনের, কেন চেনা চেনা লাগছিল কণ্ঠস্বর। সেদিন এই মহিলাই ফোনে হুঁশিয়ার করেছিল। হাইমাসের ব্যাপারে নাক না গলাতে বলেছিল।
পাহাড়ী পথ ধরে পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে যেতে শুরু করল গাড়ি, সরু গিরিপথ।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল মুসা, একটা কথা বলবেন, মিস্টার হাইমাস, ক্র্যাবকে তাড়ালেন কিভাবে?
আরে ওটা একটা গাধা, হাসল হাইমাস। নিজেকে খুব চালাক মনে করে। সেদিন রেন্ট-আ-রাইড কোম্পানিতে একটা গাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে দেখেছি ওকে, তখনই বুঝেছি। রেঞ্জারটা লোকের চোখে পড়ে তো, তাই সাধারণ একটা গাড়ি নিতে গিয়েছিলাম। রোলস রয়েসটা সেদিনই দেখলাম। তোমাদেরকে চড়তেও দেখেছি। জানলাম, একটা ওয়্যারলেস টেলিফোন আছে ওতে।
আজ তোমাদের অনুসরণ করেছি। গাড়ি থেকে নেমে পুরানো বাড়িটায় যখন ঢুকলে, কোণের একটা স্টোর থেকে গিয়ে ক্র্যাবকে ফোন করলাম। বললাম, বাড়ির ভেতর থেকে বলছি। তোমরা দুপুরের খাবার খেয়ে যাবে, যেতে দেরি হবে, সে যেন চলে যায়। বিকেলে এসে নিয়ে যায় তোমাদের। সামান্যতম সন্দেহ করল না গাধাটা। চলে গেল।
হাইম, কথাবার্তা থেকেই বোঝা গেল, মহিলা হাইমাসের স্ত্রী, তুমি নিশ্চই…
না, বাধা দিল হাইমাস, বুঝে ফেলেছে তার স্ত্রী কি বলতে চায়। রাস্তা খারাপ, দেখে চালাও। রিয়ার-ভিউ মিররে চোখ রাখছ তো?
হ্যাঁ। ছোট একটা গাড়ি একবার দেখলাম মনে হলো। এখন আর দেখছি না।
সাবধান। সামনে বাঁক।
গতি কমিয়ে তীক্ষ্ণ মোড় নিল গাড়ি। বেরিয়ে এল পাহাড়ের মাঝের লম্বা ফাঁপা একটা ফাঁকা জায়গায়। একটা বাড়ি আছে ওখানে। ডাবল গ্যারেজ। তাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো রেঞ্জারটা। ওটার পাশে এসে থামল ভ্যান।
বিচ্ছু মিয়ারা, নামো, আদেশ দিল হাইমাস। তাড়াহুড়ো করবে না। তোমাদের বিশ্বাস নেই।
ধীরে সুস্থেই নামল দুই গোয়েন্দা। পেছনে নামল হাইমাস।
চমকার সাজানো গোছানো বড় একটা লিভিং রুমে ছেলেদের নিয়ে এল হাইমাস। এক কোণে একটা টেবিল রাখা চারটে খাঁচায় চারটে হলদে ঝুঁটি কাকাতুয়া। মানুষের সাড়া যেন কানেই যায়নি পাখিগুলোর। একই ভাবে বসে রয়েছে, নীরব। হাইমাস যখন রবিন হুডের খাঁচাটা রাখল ওগুলোর পাশে, তখনও নড়ল না।
বড় সোফায় বসল রবিন আর মুসা। তাদের মুখোমুখি উল্টো দিকের আরেকটা সোফায় বসল হাইমাস, আনমনে আঙুল দিয়ে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে।
তারপর বিচ্ছুরা, বলল সে, কয়েকটা কথা জানাও তো আমাকে। সিলভারের ট্রেনিং দেয়া সাতটার মধ্যে পাঁচটা কাকাতুয়াই পেয়ে গেছি। বাকি দুটোও জোগাড় করব। তা শোঁপার খপ্পড়ে পড়লে কি করে তোমরা? কতখানি জানে সে?
শোঁপা? চোখ মিটমিট করল মুসা। রবিনের দৃষ্টি শূন্য।
না জানার ভান করে লাভ হবে না, অধৈর্য হয়ে ছুরি নাড়ল সে। শোঁপা, ওই ফরাসীটা। ইউরোপের সবচে বড় আর্ট থিফ। সাংঘাতিক লোক সে। আমার পেছনে লেগেছে।
মাথা নাড়তে যাচ্ছিল রবিন, তার আগেই বলে উঠল মুসা, মাঝারি উচ্চতা, কালো সরু গোফ, কথায় ফরাসী টান, ওই লোকটার কথা বলছেন?
হ্যাঁ। চেনো তাহলে, স্বীকার করছ।
চিনি বললে ভুল হবে, তবে দেখা হয়েছে, বলল মুসা। আরেকটু হলেই রোলস-রয়েসের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছিল ধাক্কা। ওই যে, বিলি শেকসপীয়ারকে যেদিন খুঁজতে গিয়েছিলাম, সেদিন। দোষ করল তার ড্রাইভার, উল্টে ঝগড়া লেগে গেল হ্যানসনের সঙ্গে, সব কথা খুলে বলল সে।
হ্যাঁ, ওই ব্যাটাই, বলল হাইমাস। কিন্তু শেপার হয়ে কাজ না করলে কাকাতুয়াগুলোর ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন তোমাদের?
মিস্টার ফোর্ডের হারানো কাকাতুয়া খুঁজতে গিয়ে কিভাবে জড়িয়ে পড়েছে তিন গোয়েন্দা, বলল মুসা।
শঙ্কা আর উত্তেজনা দূর হয়ে গেল হাইমাসের। ও, এই ব্যাপার। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, শোঁপার হয়ে কাজ করছ তোমরা। সেদিন হয়েছিল কি জানো? চশমা খুলে শার্টের কোণায় ডলে পরিষ্কার করে নিয়ে আবার নাকে বসাল সে। অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ফিরে দেখি রাস্তার মোড়ে বসে আছে শোঁপা। বাড়ির দিকে নজর। ঘরে ঢুকেই বুঝলাম কেউ ঢুকেছিল। কিছু খোজাখুঁজি করে গেছে। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি তো সেদিন বিশ্বাস করতে চাওনি। এখন তো মানবে? ব্যাটা ঘরে ঢুকে সেদিন নোটগুলো পড়ে গেছে।
হ্যাঁ, ঠোঁট কামড়াল মহিলা, শোঁপাই পিছে লেগেছে। তবে এখানে আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।
তা কে জানে। ছেলেদের দিকে ফিরল হাইমাস। এই পাহাড়ের মধ্যিখানে কেন বাড়ি ভাড়া নিয়েছি জানেন? শোঁপার ভয়ে। তাছাড়া কাকাতুয়াগুলো রাখারও সুবিধেমত জায়গা পাচ্ছিলাম না। রেঞ্জারটাও এখানে লুকিয়ে রাখতে পারছি। তোমরা গাড়িটা যে খুঁজছিলে, অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজারের কাছে শুনেছি। তার ছেলে বার বার নাকি জিজ্ঞেস করছিল গাড়িটার কথা। ধমক দিয়ে ছেলেকে থামিয়েছে ম্যানেজার, শাসিয়েছে, ভাড়াটের কোন কথা বাইরের কারও কাছে ফাঁস করলে ভাল হবে না। কিন্তু ধমক-ধামক দিয়ে বাচ্চাদের মুখ বন্ধ করা যায়? তাই পালিয়েই এলাম।