অভিনয় করছে না গোয়েন্দাপ্রধান।
বিচ্ছিরি রকম মোটা এক লোক দাড়িয়ে আছে, হাতে ভীষণ চেহারার একটা পুরানো আমলের পিস্তল, পিলে চমকে দেয়। পুরু লেন্সের চশমার জন্যে চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড় লাগছে, গোল গোল, যেন মাছের চোখ।
এসো, পিস্তল নাড়লো লোকটা, আগে ঘরে এসো। তারপর শুনব কেন ঢোকা হয়েছে।
মুখ শুকিয়ে গেছে মুসার, পা দুটো যেন দুই মণ ভারি। কোন মতে টেনে টেনে এসে উঠল খোয়া বিছানো পথে। খবরদার, পালানোর চেষ্টা কোরো না, হুশিয়ার করল লোকটা। তাহলে পস্তাবে।
যা বলছে, করো, মূসার কানের কাছে ফিসফিস করল কিশোর। দেখি কি হয়।
পাগলু, জবাব দিল মুসা। পালানোর চেষ্টা করব মরতে? হাঁটতেই তো পারছি না ঠিকমত।
আগে আগে চলেছে দুই গোয়েন্দা।
পেছনে মোটা লোকটার জুতোর মচমচ শব্দে শিরশির করছে মুসার গা, শুয়োপোকা দেখলে অনেকের যে অনুভূতি হয়।
বিশাল সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা, ওপরে টালির ছাউনি বেরিয়ে আছে সামনের দিকে।
দরজা খোলো, হুকুম করল লোকটা। জলদি করো। গুলি করার জন্যে আঙুল নিশপিশ করছে আমার।
নব ঘুরিয়ে ঠেলা দিল কিশোর। খুলে গেল দরজা। আবছা অন্ধকার একটা হলঘর।
ডানে ঘোরো, আবার বলল লোকটা। ওই যে, পাশের দরজাটা, খোলো।
আরেকটা বড় ঘরে ঢুকল ওরা। পুরানো আসবাবপত্র। খবরের কাগজ আর বইয়ে ঠাসা। উল্টো প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে সাজানো রয়েছে কয়েকটা বড় বড় চেয়ার, চামড়ায় মোড়া গদি।
যাও, বসো ওখানে।
যা বলা হলো, করল ওরা।
মুখখামুখি দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। মুখে সন্তুষ্টির হাসি। পিস্তলের নলের মুখে জোরে ফু দিল, যেন ভেতরে জমে থাকা বালি পরিষ্কার করছে। পথ সুগম করে দিচ্ছে বুলেটের।
এবার বলল, কি চুরি করতে এসেছ?
মিস্টার মরিসন ফোর্ডের কাছে… বলতে গিয়ে বাধা পেল কিশোর।
আমিই মরিসন ফোর্ড।
অ। আপনার কাছেই এসেছি…
কিন্তু এবারও কথা শেষ করতে দিল না ফোর্ড। নাকের একপাশ চুলকাল। আমার কাছে? তাহলে এভাবে লুকিয়ে কেন? চোরের মত?
কে যেন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করল, বলে ফেলল মুসা। তাই লুকিয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম ভেতরে চোর-ডাকাত…কত কিছুই তো ঘটছে আজকাল। দিনে-দুপুরেও লোকের বাড়িতে ডাকাত পড়ে।
অ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল লোকটার। শুনেছ, না?
মিস্টার ফোর্ড, বুঝিয়ে বলল কিশোর, মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার পাঠিয়েছেন আমাদের। আপনার নাকি একটা কাকাতুয়া হারানো গেছে, পুলিশ কিছু করতে পারছে না। সেটাই তদন্ত করতে এসেছি আমরা, পাখিটা খুঁজে বের করতে। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল সে। আমি কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু, মুসা আমান।
গোয়েন্দা, না? একনজর দেখেই কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল লোকটা। কাকাতুয়া খুঁজতে এসেছ। হাসল।
হাঁপ ছাড়ল মুসা। কিন্তু লোকটার পরের কথায়ই চুপসে গেল আবার।
তোমাদের কথা বিশ্বাস করতে তো ইচ্ছে করছে, চেহারা সুরতও ভালই, চোরের মত না। তোমরা ফিরে না গেলে খুব কান্নাকাটি করবে বাবা-মা, না?
খুব শান্ত ভাবে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল লোকটা। পিস্তলের নল প্রথমে ধরল কিশোরের বুক সোজা, তারপর ঘোরাল মুসার দিকে।
টিপে দিল ট্রিগার। চাপা একটা আওয়াজ হলো।
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল মুসা, কিছুই ঘটল না দেখে মেলল আবার।
পিস্তলের নলের মাথায় জ্বলছে নীলচে আগুন। সেটা থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিচ্ছে মিস্টার ফোর্ড। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ভকভক করে, ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে পিস্তলটা রেখে দিল টেবিলে।
হায় হায়, ভাবল মুসা, এত ভয় পেলাম। ওই সিগারেট লাইটারটা দেখে? দূর, আমি একটা ভীতুর ডিম। রক্ত ফিরে এল আবার চেহারায়। নড়েচড়ে বসল।
চমৎকার, হাসি হাসি ভাব করে বলল লোকটা। পরীক্ষায় পাশ। নাকি আমার অভিনয় ভাল হয়নি?
আরেকটু হলেই হার্টফেল করতাম, বাড়িতে ঢোকার পর এই প্রথম হাসি ফুটল মুসার মুখে। হাত মেলা। লোকটার নরম তুলতুলে হাতের চাপ খুব শক্ত, দেখে মনে হয় না এরকম হবে।
কিশোরের সঙ্গেও হাত মেলাল লোকটা। এভাবে অভিনয় করে অনেক বয়স্ক লোককেও বেহুশ করে দিয়েছি। আর তোমরা ছেলেমানুষ…ভাল গোয়েন্দাই পাঠিয়েছে ডেভিস। ও-ই বলেছিল, তোমাদের একটা টেস্ট নিতে।
মানে ইয়ে… বিশ্বাস করতে পারছে না যেন কিশোর, মিস্টার ক্রিস্টোফার বলেছেন আমাদের সাহসের পরীক্ষা নিতে!
হ্যাঁ, এই তো, একটু আগে ফোন করল। তবে তোমরা ভালই উৎরেছ। জানাব ডেভিসকে। আর হ্যাঁ, তোমাদের কিছু তদন্ত করতে হবে না, সরি।
কিন্তু আপনিই নাকি মিস্টার ক্রিস্টোফারকে জানিয়েছেন কাকাতুয়া হারিয়েছে? মুসা অবাক।
হারিয়েছিল, মাথা ঝাকাল লোকটা। তাকে জানিয়েও ছিলাম। কিন্তু ওটা যে ফিরে এসেছে, জানানো হয়নি আর। ডিয়ার বিলি, কি কষ্টটাই না দিয়েছে আমাকে।
বিলি? কিশোর জিজ্ঞেস করল, কাকাতুয়াটার নাম?
হ্যাঁ, বিলি শেকসপীয়ার, উইলিয়াম শেকসপীয়ারের…
কিন্তু বাঁচাও বাঁচাও বলে কে চেঁচাল? মুসা বলল, এ বাড়ি থেকেই…
খুব খুঁতখুঁতে তোমরা। গোয়েন্দাগিরির জন্যে ভাল। গলা ফাটিয়ে হাসল লোকটা, দুলে উঠল মস্ত ভুড়ি। ওটা বিলির কাণ্ড। নিজেকে অনেক বড় অভিনেতা ভাবে সে, মাঝেমাঝেই সেটা প্র্যাকটিস করে। আমিই শিখিয়েছিযেন হাজতে আটকে রাখা কয়েদী বিলি, তার ওপর নির্যাতন চলছে…হা-হা-হা।