গ্রীনহাউসে কাজ চলল। দিনের পর দিন ওখানে কাটাতে লাগল সিনর নয়, হয়েছে। সেজলেপলল কিশোর। ইসগুলো, ঠিক বুঝতাম, বুলি সিলভার। একেকটা কাকাতুয়ার একটা করে বিচিত্র নাম দিল। বিচিত্র সব বুলি শেখাতে লাগল। আমার কাছে খুব কঠিন মনে হত কথাগুলো, ঠিক বুঝতাম না।
হ্যাঁ, কঠিনই, মাথা দোলাল কিশোর। ইংরেজি সাহিত্য আর ইতিহাস থেকে নেয়া হয়েছে। সেজন্যেই দুর্বোধ্য ঠেকেছে তোমার কাছে। মনে আছে কোনও বুলি?
না, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ডিয়েগো। বুঝিইনি, মনে রাখব কি? একদিন একটা কাকাতুয়া মারা গেল। খুব মুষড়ে পড়ল সিনর সিলভার। শেষে আপনমনেই বলল, কি আর করা? ওটার জায়গা দখল করবে ব্ল্যাকবিয়ার্ড।
যাই হোক, ছ-টা কাকাতুয়া আর কালো কাকাতুয়াটাকে, তোমরা যেটাকে ময়না বলছ, বুলি শেখানো শেষ হলো। সিনর সিলভার নিজেও ময়নাটাকে বলত রেয়ার প্যারট।
কি জানি, নাক চুলকাল কিশোর। কোন ব্যাপারকে ঘোরাল করার জন্যেই হয়তো বলত। তারপর?
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ডিয়েগো। তারপর আর কি? চলে গেল সিনর সিলভার। যেদিন কাকাতুয়াগুলোকে বুলি শেখানো শেষ করল, সে-রাতেই। সঙ্গে নিয়ে গেল তার প্রিয় বাক্সটা। ফিরে এল তিন দিন পর আরও কাহিল, আরও রোগা হয়ে। এসেই বলল, আবার চলে যাবে। বাক্সটা সঙ্গে আনেনি কেন জিজ্ঞেস করায় বলল, ওটা নিয়ে বিপদে পড়ব আমরা। নইলে নাকি যাওয়ার আগে আমাদেরকেই দিয়ে যেত।
লম্বা একটা চিঠি লিখল সে। পোস্ট করার জন্যে দিল আমার হাতে।
ঠিকানাটা মনে আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল ডিয়েগো। না, সিনর কিশোর। অনেকগুলো টিকেট লাগাতে হয়েছে। খামের চারধারে লাল-নীল অনেক ডোরা ছিল।
এয়ার মেইলে গেছে মনে হচ্ছে, বলল মুসা। এত বেশি স্ট্যাম্প যখন লাগানো হয়েছে, ইউরোপে পাঠিয়েছে হয়তো।
কাহিল হয়ে বিছানা নিল সিনর সিলভার, বলল আবার ডিয়েগো। হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলাম। বলল দুনিয়ার কোন হাসপাতালই তাকে ভাল করতে পারবে না। বলল, আমরা তার সত্যিকার বন্ধু, আমাদের মাঝেই সে থাকতে চায়।
ভিজে এল ডিয়েগোর চোখ। খানিকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না।
অদ্ভুত লোক ছিল সিনর সিলভার, ধরা গলায় বলল ডিয়েগো। কিন্তু মনটা ছিল বড় ভাল। অদ্ভুত রসিকতা করত, ধাধা বলত, এমনকি কথাও বলত ঘুরিয়ে। আজব বুলি শিখিয়েছিল কাকাতুয়াগুলোকে। কিন্তু ভালবেসেছিল আমাদেরকে, আমরাও… কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল তার। সামলে নিয়ে বলল, সিনর সিলভার বলল, একজন খুব মোটা লোক আসবে। আমাদেরকে এক হাজার ডলার দিয়ে কাকাতুয়াগুলো কিনে নিয়ে যাবে। তারপর হাসতে শুরু করল। কাকাতুয়াগুলোকে কথা শেখানোই নাকি তার জীবনের সবচেয়ে বড় রসিকতা। তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনি। বলল, এই রসিকতা নাকি ঘাম ঝরিয়ে ছাড়বে মোটা লোকটার। হাসতে হাসতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
পরদিন সকালে আর জাগল না সিনর সিলভার, ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল ডিয়েগো।
দুই গোয়েন্দাও চুপ করে রইল। মেকসিকান ছেলেটার দুঃখ বুঝতে পারছে।
মোটা লোকটা আসেনি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল ডিয়েগো। সিনর সিলভার আমাদের বন্ধু ছিল, তার লাশ দাফন করার ভারও পড়ল আমাদের ওপর। রাস্তার ওদিকে ছোট একটা গির্জা আছে। ওখানেই তাকে কবর দিলাম। টাকা ছিল না আমাদের কাছে, বাকিতেই সব কাজ সারতে হলো। মোটা লোকটার আসার অপেক্ষায় রইলাম। এক হপ্তা গেল, দুই হপ্তা গেল, তিন হপ্তা গেল, সে এল না। ওদিকে বাকি টাকার জন্যে চাপ দিচ্ছে লোকে। শেষে বাধ্য হয়ে কাকাতুয়াগুলো নিয়ে বেরোল চাচা। হলিউডে গিয়ে বিক্রি করে এল।
লোকে কাকাতুয়া পছন্দ করে দেখলাম। একদিনেই বিক্রি হয়ে গেল সব। টাকা খুব বেশি পাওয়া গেল না, দরাদরি করলে হয়তো যেত, কিন্তু সময় একদম ছিল না। তাড়াহুড়োয় যা পেল তাতেই দিয়ে চলে এল চাচা। সিনর সিলভারের কবরের দাম শোধ করল। ভেবেছিলাম, হাজার ডলার পেলে কুঁড়েটা ঠিক হবে… অনেকক্ষণ পর হাসি ফুটল ডিয়েগোর মুখে। যাই হোক, এখন আর দুঃখ নেই। দরজা-জানালা কিনে ফেলেছি। লাগিয়ে নিলেই হলো। চাচা ভাল হয়ে আবার ফুলের চাষ শুরু করবে। আপনাকে এক হাজার ধন্যবাদ, সিনর কিশোর।
তথ্য যা জানিয়েছ, তাতে আরও কিছু পাওনা হয়ে গেছে তোমার, আশ্বাস দিল কিশোর, ভেব না। আচ্ছা, শেষতক তো মোটা লোকটা এসেছে?
এসেছে, বলল ডিয়েগো।
সি, সি, মাথা নেড়ে ভাতিজার কথায় সায় জানাল স্যানটিনোও।
কাকাতুয়াগুলো বিক্রি করে ফেলার দুই হপ্তা পর এল লোকটা, জানাল ডিয়েগো। বেচে দিয়েছি শুনে রেগে লাল। বকাবকি শুরু করল চাচাকে, শাসাল। যেখান থেকে পারে এনে দিতে বলল। শেষে নরম হলো। অনুরোধ করতে লাগল, পারলে পায়ে ধরে। কি আর করি? শেষে পেট্রল স্টেশনে থেকে গিয়ে একটা ম্যাপ চেয়ে আনলাম। চাচা লেখাপড়া জানে না, ম্যাপের কিছুই বুঝল না। তার কাছ থেকে ধারণা নিয়ে অনুমানে বের করলাম, কোন এলাকায় পাখিগুলো বিক্রি করেছে। দেখালাম মোটা লোকটাকে, ম্যাপে। আর একদণ্ড দেরি করল না সে। রেঞ্জার হাঁকিয়ে চলে গেল।
যাওয়ার আগে কার্ডটা রেখে গেল। বলে গেল, কাকাতুয়াগুলোর কোন খবর পেলেই ফোনে জানাতে। কিন্তু কোথায় পাবে চাচা খবর? পেলে তো কাজের কাজই হত। একহাজার ডলার সোজা কথা? তবে ওই টাকা ছাড়াও বাঁচতে পারব আমরা; মাথা উঁচু করে বলল ডিয়েগো। বন্ধুর কবর দিয়েছি। ঘর মেরামতের ব্যবস্থা করেছি। কোনভাবে এ-মাসের ভাড়াও জোগাড় করব। ভাল হয়ে উঠে চাচা কাজে লাগবে। মোটকা সিনর তখন আর অপমান করার সাহস পাবে না চাচাকে।