ব্ল্যাকবিয়ার্ড! বলল উত্তেজিত কিশোর। এটার জন্যেই খেপে গিয়েছিল তখন হাইমাস।
খুব খিদে পেয়েছে যেন ময়নাটার, তাকাল এদিক ওদিক।
ধারেকাছে কোন খাবার নেই, মুসার কানটা খুব লোভনীয় মনে হলো তার কাছে। দিলে কষে এক ঠোকর, লতি ছিড়ে আনার জন্যে।
আউফ, মেরে ফেলেছেরে! বলে মুসা দিল চিৎকার।
ভয় পেয়ে উড়ে গেল ময়নাটা, বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে।
গেল, মাথা কাত করল কিশোর। মুসা, একটা মূল্যবান সূত্র তাড়ালে।
আমি কি করব? রুমাল দিয়ে কানের লতি চেপে ধরেছে মুসা। ফুটো করে ফেলেছে কান। এই দেখো না, রক্ত।
প্রায় ছুটে বাইরে বেরোল কিশোর।
কিন্তু কোথাও দেখা গেল না ময়নাটাকে। চলে গেছে।
৬
ইংরেজি ভাল বলতে পারে না স্যানটিনো, তাই কিশোরের সঙ্গে কথা বলার সময় দোভাষীর কাজটা নিতে হলো ডিয়েগোকেই।
শুরুতে কয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করল কিশোর, মাথা নেড়ে শুধু সি সি, করল স্যানটিনো।
তারপর আরেকটা প্রশ্নের জবাবে চাচার হয়ে ডিয়েগো বলল, দু-বছর আগে এখানে এসেছে চাচা। মেকসিকো থেকে এসেছে গাধার গাড়িতে চড়ে। হ্যাঁ, ডিয়েগোই নিয়ে এসেছে। চাচা মালীর কাজ খুব ভাল জানে, বিশেষ করে ফুল চাষে ওস্তাদ। কিন্তু হলিউডে এসে কোন কাজ পেল না। তারপর একজন বলল, ফুলের ব্যবসা করতে। খোঁজ করতে করতে চাচা চলে এল এখানে, ভাঙা গ্রীনহাউসটার কথা শুনে। হাউসের বেশির ভাগ কাচই ভাঙা। তবু দেখেটেখে চাচার মনে হলো, কোন কোন জাতের ফুল জন্মানো সম্ভব। মাসিক পাঁচ ডলারে ভাড়া নিয়ে নিল।
পুরানো টিন জোগাড় করে লাগাল ভাঙা কাচের জায়গায়, বাতাস আর তাপ মোটামুটি ঠেকানো গেল এতে। ভাল জাতের দুর্লভ কিছু ফুলের চাষ করল ভেতরে, বাইরে লাগাল সাধারণ ফুল, আবহাওয়া আর তাপমাত্রার কমবেশিতে যেগুলোর কিছু হয় না। সেই ফুল গাধার গাড়িতে করে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, খাওয়াপরা চলে যেত কোনমতে।
চলে যাচ্ছিল। এই সময় একদিন লম্বা, রোগা এক লোক এল এখানে। তার নাম ক্যাপ্টেন লঙ জন সিলভার। রোগে ভুগে কাহিল, টাকাপয়সা নেই। এসে থাকতে চাইল। লোকটার অবস্থা দেখে মানা করতে পারল না চাচা।
সিনর সিলভারের সঙ্গে ছিল একটা নাবিকদের ব্যাগ, তাতে তার পুরানো কাপড়-চোপড়, আর একটা বাক্স। ধাতুর তৈরি, চ্যাপ্টা। এই এত বড়, হাত ছড়িয়ে দেখাল ডিয়েগো, বাক্সটা কত বড় ছিল।
সি সি, বলে মাথা নাড়ল স্যানটিনো, বোঝাল, ডিয়েগো ঠিকই বলেছে।
চোদ্দ ইঞ্চি বাই চব্বিশ, মনে মনে দ্রুত হিসেব করে নিয়ে বিড় বিড় করল কিশোর। হ্যাঁ, বলো, তারপর?
শক্ত তালা লাগানো থাকত বাক্সটায়, বলল ডিয়েগো। মাথার নিচে রেখে ঘুমাত। রোজ রাতে ডালা খুলে বাক্সের ভেতর তাকাত। খুব সুখী মনে হত তখন তাকে, মুখে হাসি ফুটত।
আবার মাথা নাড়ল স্যানটিনো, সি, সি। খুব সুখী।
চাচা একদিন সিনর সিলভারকে জিজ্ঞেস করল, বাক্সে কি আছে, ঘন চুলের বোঝায় আঙুল চালাল ডিয়েগো, মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। লোকটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল : বাক্সে আছে রামধনুর একটা টুকরো, তার তলায় একপাত্র সোনা।
রামধনুর একটা টুকরো, তার তলায় এক পাত্র সোনা, ডিয়েগোর কথার প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর, ভুরু কুঁচকে গেছে। রহস্যময় বর্ণনা। হ্যাঁ, তারপর?
চাচা অসুখে পড়ল, ভীষণ কাশি। আমাকে আসার জন্যে খবর পাঠাল মেকসিকোয়, তাকে দেখার কেউ ছিল না এখানে। এলাম। কিন্তু ফুলচাষের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারলাম না, কাজ জানি না। আমাকে এনেও বিশেষ লাভ হয়নি চাচার।
কি বলিস লাভ হয়নি? বাধা দিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে বলল স্যানটিনো। তুই এলে, আমাকে না দেখলে তো এতদিনে মরে যেতাম।
চাচা বাড়িয়ে বলে, আমাকে ভালবাসে তো, উজ্জ্বল হলো ডিয়েগোর মুখ। যাই হোক, সিনর কিশোর, আমি এসেও সিনর সিলভারকে দেখেছি। চাচার চেয়ে বেশি অসুস্থ। কি অসুখ জিজ্ঞেস করলাম। শুধু বলল, এমন এক অসুখ, যা কোনদিন সারবে না। কেন সারবে না, জিজ্ঞেস করলাম। বাক্স খুলে সোনার পাত্র থেকে সোনা বিক্রি করে ভাল ডাক্তার দেখানোর পরার্মশ দিলাম। হাসল সে। কিন্তু আমার মনে হলো, হাসি,নয়, কাদল। বলল, দুনিয়ার তাবৎ সোনা বিক্রি করেও তার রোগ সারানো যাবে না।
ও বলল… লম্বা দম নিল ডিয়েগো, মনে করার চেষ্টা করছে ঠিক কি কি বলেছিল সিলভার। ও বলল তাছাড়া পাত্রের সোনা বিক্রিও করা যাবে না। নাম ভাড়িয়ে বেআইনী ভাবে আমেরিকায় ঢুকেছে সে। বেচতে গিয়ে ধরা পড়লে পুলিশ আবার তাকে পাঠিয়ে দেবে ইংল্যাণ্ডে—যেখান থেকে এসেছে, যতদিন বাঁচে, রোজ রামধনুটা দেখে দেখে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করবে। তারপর একদিন বলল, শিগগিরই চলে যাচ্ছে সে।
মেঘ জমল ডিয়েগোর সরল নিস্পাপ চেহারায়। তখন বুঝিনি কি বলতে চেয়েছে। একদিন বাইরে থেকে সাতটা খাঁচা নিয়ে ফিরল সিনর সিলভার, সাতটায় সাতটা কাকাতুয়া। সব কটার হলদে ঝুঁটি। গ্রীনহাউসে রেখে কথা শেখাতে শুরু করল ওগুলোকে।
দ্রুত চোখে চোখে তাকাল একবার কিশোর আর মুসা। কাকাতুয়া-রহস্যের অন্ধকারে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে।
পাখি পোষ মানাতে জানত সিনর সিলভার, বলে গেল ডিয়েগো। বলতে ভুলে গেছি, ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে আগেই নিয়ে এসেছিল সে, প্রথম যখন এখানে আসে, তখনই কাঁধে ছিল কালো পাখিটা। সারাক্ষণ তার কাঁধে বসে থাকত পাখিটা, আর মুখ খারাপ করে গালাগাল করত, খুব মজা পেত সিনর সিলভার, জোরে জোরে হাসত।