উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না ডিয়েগো। লাল হয়ে উঠেছে গাল। বার বার ছুঁয়ে দেখছে গাড়ির ভেতরের সোনালি প্লেটিং, পালিশ করা গদির চামড়া। সোনালি রঙের ওয়্যারলেস টেলিফোনটা দেখে এমন ভাব করল, যেন ওটা অপার্থিব, স্বপ্ন দেখছে, ধরার জন্যে হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যাবে। বিড়বিড় করল, সোনালি আউ-টো। এত সুন্দর! চড়তে পারব কল্পনাই করিনি।
এক উচ্ছ্বসিত মুহূর্তে জানাল দুই গোয়েন্দাকে, বড় হয়ে সে গাড়ির মেকানিক হবে।
রোলস-রয়েসের পেছনে আসছে স্যালভিজ ইয়ার্ডের ঝরঝরে ঐতিহাসিক (মুসা নামটা রেখেছে। শব্দটা অনেক শুনেছে কিশোরের মুখে। বাংলাদেশে কিছু হলেই নাকি সেটা ঐতিহাসিক হয়ে যায়, তাহলে ট্রাকের ঐতিহাসিক হতে বাধা কোথায়?) ট্রাক, চালাচ্ছে বোরিস। তাতে বোঝাই করা হয়েছে ডিয়েগোর পুরস্কারের টাকায় কেনা মালপত্র। ইয়ার্ড থেকেই কিনেছে সে। কি জিনিস কিনতে চায় ডিয়েগো, শুনে অবাক হয়েছিল তিন গোয়েন্দা। কিছু শক্ত তক্তা, একটা পুরানো আস্ত দরজা, একটা জানালা, কিছু তারকাটা আর টুকিটার্কি আরও কিছু জিনিস, সবই ঘর মেরামতের কাজে লাগে। মেরিচাচীর কানে কানে তখন কি ফিসফিস করেছে। কিশোর। সব জিনিসের দাম অসম্ভব কমিয়ে ধরেছেন চাচা, কিন্তু সেটা বুঝতে দেননি ডিয়েগোকে। বলেছেন, পুরানো জিনিসের দাম ওরকমই। এতকিছু কেনার পরেও পুরস্কারের পাঁচ ডলার বেঁচে গেছে, পকেটে বার বার হাত ঢুকিয়ে দেখছে ডিয়েগো, তার জন্যে এটা এখন রাজার সম্পদ।
জিনিসপত্র সব ভোলার পর সমস্যা দেখা দিয়েছিল ডিয়েগোর গাধা আর গাড়িটা নিয়ে। কি ভাবে নেয়া হবে? সমাধান করে দিয়েছে বোরিস আর রোভার। ওই দুটোও তুলে দিয়েছে ট্রাকের পেছনে। রাস্তায় লোক হাঁ করে দাড়িয়ে যাচ্ছে, কৌতূহলী চোখে দেখছে বিচিত্র মিছিলটাকে।
একটা অত্যন্ত দরিদ্র পল্লীতে এসে ঢুকল রোলস-রয়েস। ছোট ছোট কুঁড়ে, ঠেকাইকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে কোনমতে, বেশির ভাগই ভাঙা। একপাশে ফসলের মাঠ, ছোট। এখানেই থাকে ডিয়েগো আর তার চাচা।
গাড়ি দেখে হই-চই করে এসে ঘিরে ধরল বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল।
জানালা দিয়ে হাত বের করে ওদের উদ্দেশ্যে নাড়ল ডিয়েগো। রোসি! চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকল সে। টিরাননা! নোলিটা! আমি, আরে আমি, ডিয়েগো। সোনালি আউ-টোতে চড়ছি।
হাঁকডাক শুনে ঘর থেকে আরও ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এল, পঙ্গপালের মত ছেকে ধরল। গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো হ্যানসন, পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে বাচ্চারা।
সবাই ছুঁয়ে দেখতে চায় রোলস-রয়েস।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে হুশিয়ার করল ওদেরকে ডিয়েগো, স্প্যানিশ ভাষায় ধমক-ধামক দিল। পিছিয়ে গেল ওরা।
এগোব, মাস্টার পাশা? অনুমতি চাইল হ্যানসন। আশ্চর্য শান্ত মেজাজ। অন্য ড্রাইভার হলে রেগে বাচ্চার দলকে গালাগাল শুরু করত এতক্ষণে।
না, পেছনে তাকিয়ে রয়েছে ডিয়েগো। খানিকটা ভোলা জায়গার পর পড়ো পড়ো একটা কুঁড়ে, তার পেছনে ক্ষত-বিক্ষত একটা গ্রীন হাউস। ওটাই আমাদের ঘর। গাড়ি নেয়ার দরকার কি? হেঁটেই তো যেতে পারি। পথও খুব খারাপ। এত সুন্দর গাড়িটা চোট পাবে, গদিমোড়া দেয়ালে হাত বোলাল সে।
প্রস্তাবটা মনে ধরল কিশোরের। নেমে এল তিন কিশোর।
থ্যাংক ইউ, হ্যানসন, কিশোর বলল। গাড়ি আর লাগবে না। ট্রাকে করেই ফিরতে পারব। আপনার আয় কষ্ট করে লাভ নেই? চলে যান।
বোরিস ট্রাক নিয়ে পৌঁছেছে।
তাকে বলল কিশোর, আপনি ওই বাড়িটার সামনে যান। আমরা যাচ্ছি।
স্বভাব-খসখসে গলায় হোকে (ও-কে) বলে এগোল বোরিস।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল হ্যানসন।
মেকসিকো থেকে যখন এল চাচা, পকেট খালি, হাঁটতে হাঁটতে বলল ডিয়েগো। এখানেই এসে উঠল। ওই বাড়িটা মাত্র পাঁচ ডলারে ভাড়া নিয়েছে চাচা। মাস মাস সেটা দিতেই অবস্থা কাহিল। এখন একমাসের ভাড়া আছে আমার পকেটে। কিছুদিন আর খাটতে হবে না চাচাকে, শুয়ে থাকতে পারলে তার কাশি ভাল হয়ে যাবে। তখন আবার ভালমত কাজ করতে পারবে।
বাড়ির পেছন দিক দিয়ে এসেছে ওরা, তাই এতক্ষণ কালো গাড়িটা চোখে পড়েনি। সামনের দিকে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে ওটা। না, রেঞ্জার নয়, সেডান।
ভ্রূকুটি করল ডিয়েগো। গাড়ি নিয়ে কে আবার এল? কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল, ব্যাপার সুবিধের লাগছে না তার। দৌড় দিল।
পেছনে ছুটল কিশোর আর মুসা। কুঁড়ের আরও কাছে আসতেই ধমক শোনা গেল।
হাইমাস, গতি বাড়াল মুসা।
বল, বলছে লোকটা, জলদি বল, শুয়োর কোথাকার, নইলে ঘাড় মটকে দেব!
চাচা! চেঁচিয়ে উঠল ডিয়েগো।
দরজার জায়গায় কিছুই নেই, খোলা। ছুটে ঢুকে পড়ল ডিয়েগো। পেছনে দুই গোয়েন্দা।
মলিন বিছানায় চিত হয়ে আছে একজন লোক, নিশ্চয় আঙ্কেল স্যানটিনো। তার ওপর ঝুকে রয়েছে মোটা হাইমাস।
মনে কর ব্যাটা! আবার চেঁচাল হাইমাস। কোথায় বেচেছিস? আরগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম, কিন্তু ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কথা তো মনে থাকার কথা। অনেক ঘুরেছিস ওটা নিয়ে, সবশেষে বেচেছিস। নিশ্চয় মনে আছে তোর, বলছিস না। সেফ শয়তানী। চারটে পেয়েছি। আরগুলো কোথায়?
শিকারী কুকুরের মত গিয়ে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডিয়েগো।
কিন্তু টলল না দানব। হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিল রোগা ছেলেটাকে, যেন পোকা তাড়াল। তারপর ঘুরল ঝটকা দিয়ে।