শিষ্য॥ মহাশয়, লোক-কল্যাণে তৎপর যথার্থ সন্ন্যাসী কয়জন দেখিতে পাওয়া যায়?
স্বামীজী॥ হাজার বৎসর অন্তর যদি ঠাকুরের ন্যায় একজন সন্ন্যাসী মহাপুরুষ আসেন তো ভরপুর। তিনি যে-সকল উচ্চ আদর্শ ও ভাব দিয়ে যাবেন, তা নিয়ে তাঁর জন্মাবার হাজার বৎসর পর অবধি লোক চলবে। এই সন্ন্যাস institution (আশ্রম) দেশে ছিল বলেই তো তাঁর ন্যায় মহাপুরুষেরা এদেশে জন্মগ্রহণ করছেন। দোষ সব আশ্রমেই আছে, তবে অল্পাধিক। দোষ সত্ত্বেও এতদিন পর্যন্ত যে এই আশ্রম সকল আশ্রমের শীর্ষস্থান অধিকার করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার কারণ কি? যথার্থ সন্ন্যাসীরা নিজেদের মুক্তি পর্যন্ত উপেক্ষা করেন, জগতের ভাল করতেই তাঁদের জন্ম। এমন সন্ন্যাসাশ্রমের প্রতি যদি তোরা কৃতজ্ঞ না হস তো তোদের ধিক—শত ধিক।
বলিতে বলিতে স্বামীজীর মুখমণ্ডল প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। সন্ন্যাসাশ্রমের গৌরবপ্রসঙ্গে স্বামীজী যেন মূর্তিমান্ ‘সন্ন্যাস’রূপে শিষ্যের চক্ষে প্রতিভাত হইতে লাগিলেন।
অনন্তর ঐ আশ্রমের গৌরব তিনি প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতে করিতে যেন অন্তর্মুখ হইয়া আপনা-আপনি মধুর স্বরে আবৃত্তি করিতে লাগিলেনঃ
বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তঃ
ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ।
অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ
কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ॥২১
পরে আবার বলিতে লাগিলেনঃ
বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। সন্ন্যাস গ্রহণ করে যে এই ideal (উচ্চ লক্ষ্য) ভুলে যায় ‘বৃথৈব তস্য জীবনম্।’ পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবের গগণভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে, পুত্রবিয়োগ-বিধুরার প্রাণে শান্তিদান করতে, অজ্ঞ ইতরসাধারণকে জীবন-সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ-বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানালোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্ম-সিংহকে জাগরিত করতে জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।
গুরুভ্রাতাদের লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেনঃ
‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আমাদের জন্ম; কি করছিস সব বসে বসে? ওঠ—জাগ, নিজে জেগে অপর সকলকে জাগ্রত কর, নরজন্ম সার্থক করে চলে যা। ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’
৮
স্থান—আলমবাজার মঠ
কাল—মে, ১৮৯৭
দার্জিলিঙ হইতে স্বামীজী কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছেন। আলমবাজার মঠেই অবস্থান করিতেছেন। গঙ্গাতীরে কোন স্থানে মঠ উঠাইয়া লইবার জল্পনা হইতেছে। শিষ্য আজকাল প্রায়ই মঠে তাঁহার নিকটে যাতায়াত করে এবং মধ্যে মধ্যে রাত্রিতে অবস্থানও করিয়া থাকে। দীক্ষাগ্রহণে কৃতসঙ্কল্প হইয়া শিষ্য স্বামীজীকে দার্জিলিঙে ইতঃপূর্বে পত্র লিখিয়া জানাইয়াছিল। স্বামীজী তদুত্তরে লিখেন, নাগ-মশায়ের আপত্তি না হলে তোমাকে অতি আনন্দের সহিত দীক্ষিত করব।
১৩০৩ সালের ১৯ বৈশাখ। স্বামীজী আজ শিষ্যকে দীক্ষা দিবেন বলিয়াছেন। আজ শিষ্যের জীবনে সর্বাপেক্ষা বিশেষ দিন। শিষ্য প্রত্যুষে গঙ্গাস্নানান্তে কতকগুলি লিচু ও অন্য দ্রব্যাদি কিনিয়া বেলা ৮টা আন্দাজ আলমবাজার মঠে উপস্থিত হইয়াছেন। শিষ্যকে দেখিয়া স্বামীজী রহস্য করিয়া বলিলেন, আজ তোকে ‘বলি’ দিতে হবে—না?
স্বামীজী শিষ্যকে ঐ কথা বলিয়া আবার হাস্যমুখে সকলের সঙ্গে আমেরিকার নানা প্রসঙ্গ করিতে লাগিলেন। ধর্মজীবন গঠন করিতে হইলে কিরূপ একনিষ্ঠ হইতে হয়, গুরুতে কিরূপ অচল বিশ্বাস ও দৃঢ় ভক্তিভাব রাখিতে হয়, গুরুবাক্যে কিরূপ আস্থা স্থাপন করিতে হয় এবং গুরুর জন্য কিরূপে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হইতে হয়—এ-সকল প্রসঙ্গও সঙ্গে সঙ্গে হইতে লাগিল। অনন্তর তিনি শিষ্যকে কতকগুলি প্রশ্ন করিয়া তাহার হৃদয় পরীক্ষা করিতে লাগিলেনঃ ‘আমি তোকে যখন যে কাজ করতে বলব, তখনি তা যথাসাধ্য করবি তো? যদি গঙ্গায় ঝাঁপ দিলে বা ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়লে তোর মঙ্গল হবে বুঝে তাই করতে বলি, তা হলে তাও নির্বিচারে করতে পারবি তো? এখনও ভেবে দেখ; নতুবা সহসা গুরু বলে গ্রহণ করতে এগোসনি।’—এইরূপে কয়েকটি প্রশ্ন করিয়া স্বামীজী শিষ্যের বিশ্বাসের দৌড়টা বুঝিতে লাগিলেন। শিষ্যও নতশিরে ‘পারিব’ বলিয়া প্রতি প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিল।
স্বামীজী॥ যিনি এই সংসার-মায়ার পারে নিয়ে যান, যিনি কৃপা করে সমস্ত মানসিক আধিব্যাধি বিনিষ্ট করেন, তিনিই যথার্থ গুরু। আগে শিষ্যরা ‘সমিৎপাণি’ হয়ে গুরুর আশ্রমে যেত। গুরু—অধিকারী বলে বুঝলে তাকে দীক্ষিত করে বেদপাঠ করাতেন এবং কায়মনোবাক্যদণ্ড-রূপ ব্রতের চিহ্নস্বরূপ ত্রিরাবৃত্ত মৌঞ্জিমেখলা তার কোমরে বেঁধে দিতেন। ঐটে দিয়ে শিষ্যেরা কৌপীন এঁটে বেঁধে রাখত। সেই মৌঞ্জিমেখলার স্থানে পরে যজ্ঞসূত্র বা পৈতে পরার পদ্ধতি হয়।
শিষ্য॥ তবে কি, মহাশয়, আমাদের মত সূতার পৈতা পরাটা বৈদিক প্রথা নয়?
স্বামীজী॥ বেদে কোথাও সুতোর পৈতের কথা নেই। স্মার্ত ভট্টাচার্য রঘুনন্দনও লিখেছেন, ‘অস্মিন্নেব সময়ে যজ্ঞসূত্রং পরিধাপয়েৎ।’ সুতোর পৈতের কথা গোভিল গৃহ্যসূত্রেও নেই। গুরুসমীপে এই প্রথম বৈদিক সংস্কারই শাস্ত্রে ‘উপনয়ন’ বলে উক্ত হয়েছে। কিন্তু আজকাল দেশের কি দুরবস্থাই না হয়েছে! শাস্ত্রপথ পরিত্যাগ করে কেবল কতকগুলো দেশাচার, লোকাচার ও স্ত্রী-আচারে দেশটা ছেয়ে ফেলেছে। তাই তো তোদের বলি, তোরা প্রাচীন কালের মত শাস্ত্রপথ ধরে চল। নিজেরা শ্রদ্ধাবান্ হয়ে দেশে শ্রদ্ধা নিয়ে আয়। নচিকেতার মত শ্রদ্ধা হৃদয়ে আন। নচিকেতার মত যমলোকে চলে যা—আত্মতত্ত্ব জানবার জন্য, আত্ম-উদ্ধারের জন্য, এই জন্ম-মরণ প্রহেলিকার যথার্থ মীমাংসার জন্য যমের মুখে গেলে যদি সত্যলাভ হয়, তা হলে নির্ভীক হৃদয়ে যমের মুখে যেতে হবে। ভয়ই তো মৃত্যু। ভয়ের পরপারে যেতে হবে। আজ থেকে ভয়শূন্য হ। যা চলে—আপনার মোক্ষ ও পরার্থে দেহ দিতে। কি হবে কতকগুলো হাড়মাসের বোঝা বয়ে? ঈশ্বরার্থে সর্বস্বত্যাগ-রূপ মন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ করে দধীচি মুনির মত পরার্থে হাড়মাস দান কর। শাস্ত্রে বলে—যাঁরা অধীত বেদবেদান্ত, যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞ, যাঁরা অপরকে অভয়ের পারে নিতে সমর্থ, তাঁরাই যথার্থ গুরু; তাঁদের পেলেই দীক্ষিত হবে—‘নাত্র কার্যবিচারণা।’ এখন সেটা কেমন দাঁড়িয়েছে জানিস—‘অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ।’২২