ইহাদের মধ্যে একজনকে যাহাতে সন্ন্যাস না দেওয়া হয়, সেজন্য স্বামীজীর গুরুভ্রাতৃগণ তাঁহাকে বহুধা অনুরোধ করেন। স্বামীজী তদুত্তরে বলিয়াছিলেন, ‘আমরা যদি পাপী তাপী দীন দুঃখী পতিতের উদ্ধারসাধনে পশ্চাৎপদ হই, তা হলে কে আর তাকে দেখবে? তোমরা এ-বিষয়ে কোনরূপ প্রতিবাদী হইও না।’ স্বামীজীর বলবতী ইচ্ছাই পূর্ণ হইল। অনাথশরণ স্বামীজী নিজ কৃপাগুণে তাহাকে সন্ন্যাস দিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন।
শিষ্য আজ দুই দিন হইতে মঠেই রহিয়াছে। স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘তুই তো ভট্চায বামুন; আগামী কাল তুই-ই এদের শ্রাদ্ধ১৬ করিয়ে দিবি, পরদিন এদের সন্ন্যাস দিব। আজ পাঁজি-পুঁথি সব পড়ে শুনে দেখে নিস।’ শিষ্য স্বামীজীর আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া লইল।
শ্রাদ্ধান্তে যখন ব্রহ্মচারিচতুষ্টয় নিজ নিজ পিণ্ড অর্পণ করিয়া পিণ্ডাদি লইয়া গঙ্গায় চলিয়া গেলেন, তখন স্বামীজী শিষ্যের মনের অবস্থা লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘এ-সব দেখে শুনে তোর মনে ভয় হয়েছে—না রে?’ শিষ্য নতমস্তকে সম্মতি জ্ঞাপন করায় স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেনঃ
সংসারে আজ থেকে এদের মৃত্যু হল, কাল থেকে এদের নূতন দেহ, নূতন চিন্তা, নূতন পরিচ্ছদ হবে—এরা ব্রহ্মবীর্যে প্রদীপ্ত হয়ে জ্বলন্ত পাবকের মত অবস্থান করবে। ন ধননে ন চেজ্যয়া … ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ।১৭
স্বামীজীর কথা শুনিয়া শিষ্য নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সন্ন্যাসের কঠোরতা স্মরণ করিয়া তাহার বুদ্ধি স্তম্ভিত হইয়া গেল, শাস্ত্রজ্ঞানের আস্ফালন দূরীভূত হইল।
কৃতশ্রাদ্ধ ব্রহ্মচারিচতুষ্টয় ইতোমধ্যে গঙ্গাতে পিণ্ডাদি নিক্ষেপ করিয়া আসিয়া স্বামীজীর পাদপদ্ম বন্দনা করিলেন। স্বামীজী তাঁহাদিগকে আশীর্বাদ করিয়া বলিলেনঃ
তোমরা মানব-জীবনের শ্রেষ্ঠব্রত গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছ; ধন্য তোমাদের জন্ম, ধন্য তোমাদের বংশ, ধন্য তোমাদের গর্ভধারিণী—‘কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা।’
সেইদিন রাত্রে আহারান্তে স্বামীজী কেবল সন্ন্যাসধর্ম-বিষয়েই কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। সন্ন্যাসব্রতগ্রহণোৎসুক ব্রহ্মচারিগণকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেনঃ
‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’—এই হচ্ছে সন্ন্যাসের প্রকৃত উদ্দেশ্য। সন্ন্যাস না হলে কেউ কখনও ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারে না—এ কথা বেদ-বেদান্ত ঘোষণা করছে। যারা বলে—এ সংসারও করব, ব্রহ্মজ্ঞও হব—তাদের কথা আদপেই শুনবিনি। ও-সব প্রচ্ছন্নভোগীদের স্তোকবাক্য। এতটুকু সংসারের ভোগেচ্ছা যার রয়েছে, এতটুকু কামনা যার রয়েছে, এ কঠিন পন্থা ভেবে তার ভয়; তাই আপনাকে প্রবোধ দেবার জন্য বলে বেড়ায়, ‘একূল ওকূল দুকূল রেখে চলতে হবে।’ ও পাগলের কথা, উন্মত্তের প্রলাপ অশাস্ত্রীয় অবৈদিক মত। ত্যাগ ছাড়া মুক্তি নেই। ত্যাগ ছাড়া পরাভক্তি লাভ হয় না। ত্যাগ—ত্যাগ। ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ গীতাতেও আছে—‘কাম্যানাং কর্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ।’১৮
সংসারের ঝঞ্ঝাট ছেড়ে না দিলে কারও মুক্তি হয় না। সংসারাশ্রমে যে রয়েছে, একটা না একটা কামনার দাস হয়েই যে সে ঐরূপে বদ্ধ রয়েছে, ওতেই তা প্রমাণ হচ্ছে। নইলে সংসারে থাকবে কেন? হয় কামিনীর দাস, নয় অর্থের দাস, নয় মান যশ বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের দাস। এ দাসত্ব থেকে বেরিয়ে পড়লে তবে মুক্তির পন্থায় অগ্রসর হতে পারা যায়। যে যতই বলুক না কেন, আমি বুঝেছি, এ-সব ছেড়ে-ছুড়ে না দিলে, সন্ন্যাস গ্রহণ না করলে কিছুতেই জীবের পরিত্রাণ নেই, কিছুতেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের সম্ভাবনা নেই।
শিষ্য॥ মহাশয়, সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেই কি সিদ্ধিলাভ হয়?
স্বামীজী॥ সিদ্ধ হয় কিনা হয় পরের কথা। তুই যতক্ষণ না এই ভীষণ সংসারের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে পড়তে পারছিস—যতক্ষণ না বাসনার দাসত্ব ছাড়তে পারছিস, ততক্ষণ তোর ভক্তি মুক্তি কিছুই লাভ হবে না। ব্রহ্মজ্ঞের কাছে সিদ্ধি ঋদ্ধি অতি তুচ্ছ কথা।
শিষ্য॥ মহাশয়, সন্ন্যাসের কোনরূপ কালাকাল বা প্রকার-ভেদ আছে কি?
স্বামীজী॥ সন্ন্যাসধর্ম-সাধনের কালাকাল নেই। শ্রুতি বলছেন, ‘যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্রব্রজেৎ’—যখনি বৈরাগ্যের উদয় হবে, তখনি প্রব্রজ্যা করবে।১৯ যোগবাশিষ্ঠেও রয়েছে—
যুবৈব ধর্মশীলঃ স্যাদ্ অনিত্যং খলু জীবিতং।
কো হি জানাতি কস্যাদ্য মৃত্যুকালো ভবিষ্যতি॥
জীবনের অনিত্যতাবশতঃ যুবাকালেই ধর্মশীল হবে। কে জানে কার কখন দেহ যাবে? শাস্ত্রে চতুর্বিধ সন্ন্যাসের বিধান দেখতে পাওয়া যায়—বিদ্বৎ সন্ন্যাস, বিবিদিষা সন্ন্যাস, মর্কট সন্ন্যাস এবং আতুর সন্ন্যাস। হঠাৎ ঠিক ঠিক বৈরাগ্য হল, তখনি সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লে—এটি পূর্ব জন্মের সংস্কার না থাকলে হয় না। এরই নাম ‘বিদ্বৎ সন্ন্যাস।’ আত্মতত্ত্ব জানবার প্রবল বাসনা থেকে শাস্ত্রপাঠ ও সাধনাদি দ্বারা স্ব-স্বরূপ অবগত হবার জন্য কোন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের কাছে সন্ন্যাস নিয়ে স্বাধ্যায় ও সাধন ভজন করতে লাগল—একে ‘বিবিদিষা সন্ন্যাস’ বলে। সংসারের তাড়না, স্বজনবিয়োগ বা অন্য কোন কারণে কেউ কেউ বেরিয়ে পড়ে সন্ন্যাস নেয়; কিন্তু এ বৈরাগ্য স্থায়ী হয় না, এর নাম ‘মর্কট সন্ন্যাস’। ঠাকুর যেমন বলতেন, বৈরাগ্য নিয়ে পশ্চিমে গিয়ে আবার একটা চাকরি বাগিয়ে নিলে; তারপর চাই কি পরিবার আনলে বা আবার বে করে ফেললে। আর এক প্রকার সন্ন্যাস আছে, যেমন মুমূর্ষু, রোগশয্যায় শায়িত, বাঁচবার আশা নেই, তখন তাকে সন্ন্যাস দেবার বিধি আছে। সে যদি মরে তো পবিত্র সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে মরে গেল—পরজন্মে এই পুণ্যে ভাল জন্ম হবে। আর যদি বেঁচে যায় তো আর গৃহে না গিয়ে ব্রহ্মজ্ঞান-লাভের চেষ্টায় সন্ন্যাসী হয়ে কালযাপন করবে। তোর কাকাকে শিবানন্দ স্বামী ‘আতুর সন্ন্যাস’ দিয়েছিলেন। সে মরে গেল, কিন্তু ঐরূপে সন্ন্যাসগ্রহণে তার উচ্চ জন্ম হবে। সন্ন্যাস না নিলে আত্মজ্ঞানলাভের আর উপায়ান্তর নেই।