ইতোমধ্যে গিরিশবাবু শিষ্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘দেখলি বাঙাল, কত বড় প্রাণ! তোর স্বামীজীকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না; কিন্তু ঐ যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, মহাপ্রাণতার জন্য মানি। চোখের সামনে দেখলি তো মানুষের দুঃখকষ্টের কথাগুলো শুনে করুণায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে স্বামীজীর বেদ-বেদান্ত সব কোথায় উড়ে গেল!’
শিষ্য॥ মহাশয়, আমাদের বেশ বেদ পড়া হইতেছিল; আপনি মায়ার জগতের কি কতকগুলো ছাইভস্ম কথা তুলিয়া স্বামীজীর মন খারাপ করিয়া দিলেন।
গিরিশবাবু॥ জগতে এই দুঃখকষ্ট, আর উনি সে দিকে একবার না চেয়ে চুপ করে বসে কেবল বেদ পড়ছেন! রেখে দে তোর বেদ-বেদান্ত।
শিষ্য॥ আপনি কেবল হৃদয়ের ভাষা শুনিতেই ভালবাসেন, নিজে হৃদয়বান্ কিনা! কিন্তু এই সব শাস্ত্র, যাহার আলোচনায় জগৎ ভুল হইয়া যায়, তাহাতে আপনার আদর দেখিতে পাই না। নতুবা এমন করিয়া আজ রসভঙ্গ করিতেন না।
গিরিশবাবু॥ বলি জ্ঞান আর প্রেমের পৃথক্ত্বটা কোথায় আমায় বুঝিয়ে দে দেখি। এই দেখ্ না, তোর গুরু (স্বামীজী) যেমন পণ্ডিত তেমনি প্রেমিক। তোর বেদও বলছে না ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’ তিনটে একই জিনিষ? এই দেখ্ না, স্বামীজী অত পাণ্ডিত্য প্রকাশ করছিলেন, কিন্তু যাই জগতের দুঃখের কথা শোনা ও মনে পড়া, অমনি জীবের দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। জ্ঞান আর প্রেমে যদি বেদবেদান্ত বিভিন্নতা প্রমাণ করে থাকেন তো অমন বেদ-বেদান্ত আমার মাথায় থাকুন।
শিষ্য নির্বাক হইয়া ভাবিতে লাগিল, সত্যই তো গিরিশবাবু সিদ্ধান্তগুলি বেদের অবিরোধী।
ইতোমধ্যে স্বামীজী আবার ফিরিয়া আসিলেন এবং শিষ্যকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘কি রে তোদের কি কথা হচ্ছিল?’
শিষ্য॥ এই সব বেদের কথাই হইতেছিল। ইনি এ-সকল গ্রন্থ পড়েন নাই, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলি বেশ ঠিক ঠিক ধরিতে পারিয়াছেন—বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।
স্বামীজী॥ গুরুভক্তি থাকলে সব সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ হয়—পড়বার শুনবার দরকার হয় না। তবে এরূপ ভক্তি ও বিশ্বাস জগতে দুর্লভ। ওর (গিরিশবাবু) মত যাঁদের ভক্তি বিশ্বাস, তাঁদের শাস্ত্র পড়বার দরকার নেই। কিন্তু ওকে (গিরিশবাবুকে) imitate (অনুকরণ) করতে গেলে অন্যের সর্বনাশ উপস্থিত হবে। ওর কথা শুনে যাবি, কিন্তু কখনও ওর দেখাদেখি কাজ করতে যাবি না।
শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ।
স্বামীজী॥ আজ্ঞে হাঁ নয়। যা বলি সে-সব কথাগুলি বুঝে নিবি, মূর্খের মত সব কথায় কেবল সায় দিয়ে যাবি না। আমি বললেও বিশ্বাস করবিনি। বুঝে তবে নিবি। আমাকে ঠাকুর তাঁর কথা সব বুঝে নিতে সর্বদা বলতেন। সদ্যুক্তি, তর্ক ও শাস্ত্রে যা বলেছে, এই সব নিয়ে পথে চলবি। বিচার করতে করতে বুদ্ধি পরিষ্কার হয়ে যাবে, তবে তাইতে ব্রহ্ম reflected (প্রতিফলিত) হবেন। বুঝলি?
শিষ্য॥ হাঁ। কিন্তু নানা লোকের নানা কথায় মাথা ঠিক থাকে না। এই একজন (গিরিশবাবু) বলিলেন, কি হবে ও-সব পড়ে? আবার এই আপনি বলিতেছেন বিচার করিতে। এখন করি কি?
স্বামীজী॥ আমাদের উভয়ের কথাই সত্যি। তবে দুই standpoint (দিক্) থেকে আমাদের দু- জনের কথাগুলি বলা হচ্ছে—এই পর্যন্ত। একটা অবস্থা আছে, যেখানে যুক্তি তর্ক সব চুপ হয়ে যায় ‘মূকাস্বাদনবৎ’। আর একটা অবস্থা আছে, যাতে বেদাদি শাস্ত্রগ্রন্থের আলোচনা পঠন-পাঠন করতে করতে সত্যবস্তু প্রত্যক্ষ হয়। তোকে এসব পড়ে শুনে যেতে হবে, তবে তোর সত্য প্রত্যক্ষ হবে। বুঝলি?
নির্বোধ শিষ্য স্বামীজীর ঐরূপ আদেশলাভে গিরিশবাবুর হার হইল মনে করিয়া গিরিশবাবুর দিকে চাহিয়া বলিতে লাগিল, ‘মহাশয়, শুনিলেন তো স্বামীজী আমায় বেদবেদান্ত পড়িতে ও বিচার করিতেই বলিলেন।’
গিরিশবাবু॥ তা তুই করে যা। স্বামীজীর আশীর্বাদে তোর তাই করেই সব ঠিক হবে।
স্বামী সদানন্দ এই সময়ে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। স্বামীজী তাঁহাকে দেখিয়াই বলিলেন, ‘ওরে, এই জি. সি-র মুখে দেশের দুর্দশার কথা শুনে প্রাণটা আঁকুপাঁকু করছে। দেশের জন্য কিছু করতে পারিস?’
সদানন্দ॥ মহারাজ! যো হুকুম—বান্দা তৈয়ার হ্যায়।
স্বামীজী॥ প্রথমে ছোটখাট scale-এ (হারে) একটা relief centre (সেবাশ্রম) খোল, যাতে গরীব-দুঃখীরা সব সাহায্য পাবে, রোগীদের সেবা করা হবে, যাদের কেউ দেখবার নেই—এমন অসহায় লোকদের জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সেবা করা হবে। বুঝলি?
সদানন্দ॥ যো হুকুম মহারাজ!
স্বামীজী॥ জীবসেবার চেয়ে আর ধর্ম নেই। সেবাধর্মের ঠিক ঠিক অনুষ্ঠান করতে পারলে অতি সহজেই সংসারবন্ধন কেটে যায়—‘মুক্তিঃ করফলায়তে।’
এইবার গিরিশবাবুকে সম্বোধন করিয়া স্বামীজী বলিলেনঃ
দেখ গিরিশবাবু, মনে হয়—এই জগতের দুঃখ দূর করতে আমায় যদি হাজারও জন্ম নিতে হয়, তাও নেব। তাতে যদি কারও এতটুকু দুঃখ দূর হয় তো তা করব। মনে হয়, খালি নিজের মুক্তি নিয়ে কি হবে? সকলকে সঙ্গে নিয়ে ঐ পথে যেতে হবে। কেন বল দেখি এমন ভাব ওঠে?
গিরিশবাবু॥ তা না হলে আর তিনি (ঠাকুর) তোমায় সকলের চেয়ে বড় আধার বলতেন!
এই বলিয়া গিরিশবাবু কার্যান্তরে যাইবেন বলিয়া বিদায় লইলেন।
৭
স্থান—আলমবাজার মঠ, কলিকাতা
কাল—এপ্রিল, ১৮৯৭
প্রথমবার বিলাত হইতে ফিরিয়া স্বামীজী যখন কিছুদিন কলিকাতায় ছিলেন, তখন বহু উৎসাহী যুবক তাঁহার নিকট যাতায়াত করিত। দেখা গিয়াছে, সেই সময় স্বামীজী অবিবাহিত যুবকগণকে ব্রহ্মচর্য ও ত্যাগের বিষয় সর্বদা উপদেশ দিতেন এবং সন্ন্যাস অথবা আপনার মোক্ষ ও জগতের কল্যাণার্থ সর্বস্ব ত্যাগ করিতে বহুধা উৎসাহিত করিতেন। আমরা তাঁহাকে অনেক সময় বলিতে শুনিয়াছি, সন্ন্যাস গ্রহণ না করিলে কাহারও যথার্থ আত্মজ্ঞান লাভ হইতে পারে না; কেবল তাহাই নহে, বহুজনহিতকর, বহুজনসুখকর কোন ঐহিক কার্যের অনুষ্ঠান এবং তাহাতে সিদ্ধিলাভ করাও সন্ন্যাস ভিন্ন হয় না। তিনি সর্বদা ত্যাগের উচ্চাদর্শ উৎসাহী যুবকদের সমক্ষে স্থাপন করিতেন এবং কেহ সন্ন্যাস গ্রহণ করিবে, এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে তাহাকে সমধিক উৎসাহ দিতেন ও কৃপা করিতেন। এই সময় কতিপয় ভাগ্যবান্ যুবক সংসার-আশ্রম ত্যাগ করিয়া তাঁহার দ্বারাই সন্ন্যাসাশ্রমে দীক্ষিত হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে যে চারিজনকে১৫ স্বামীজী প্রথম সন্ন্যাস দেন, তাহাদের সন্ন্যাসব্রতগ্রহণের দিন শিষ্য আলমবাজার মঠে উপস্থিত ছিল।