ঠাকুর কিন্তু সিদ্ধাই-এর বড় নিন্দা করতেন; বলতেন, ‘ঐ-সকল শক্তি-প্রকাশের দিকে মন দিলে পরমার্থ-তত্ত্বে পৌঁছান যায় না।’ কিন্তু মানুষের এমনি দুর্বল মন, গৃহস্থের তো কথাই নেই, সাধুদের মধ্যেও চৌদ্দ আনা লোক সিদ্ধাই-এর উপাসক হয়ে পড়ে। পাশ্চাত্য দেশে ঐ প্রকার বুজরুকি দেখলে লোকে অবাক হয়ে যায়। সিদ্ধাই-লাভটা যে একটা খারাপ জিনিষ, ধর্মপথের অন্তরায়, এ কথা ঠাকুর কৃপা করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, তাই বুঝতে পেরেছি। সে-জন্য দেখিসনি—ঠাকুরের সন্তানেরা কেউই ঐ দিকে খেয়াল রাখে না?
স্বামী যোগানন্দ এই সময়ে স্বামীজীকে বলিলেন, ‘তোমার সঙ্গে মান্দ্রাজে যে একটা ভূতুড়ের দেখা হয়েছিল, সেই কথাটা বাঙালকে বল না।’
শিষ্য ঐ বিষয় ইতঃপূর্বে শুনে নাই, শুনিবার জন্য জেদ করিয়া বসিলে অগত্যা স্বামীজী ঐ কথা এইরূপে বলিলেনঃ
মান্দ্রাজে যখন মন্মথবাবুর৪১ বাড়ীতে ছিলুম, তখন একদিন স্বপ্ন দেখলুম—মা৪২ মারা গেছেন! মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল। তখন মঠেও বড় একটা চিঠিপত্র লিখতুম না—তা বাড়ীতে লেখা তো দূরের কথা। মন্মথবাবুকে স্বপ্নের কথা বলায় তিনি তখনই ঐ বিষয়ের সংবাদের জন্য কলিকাতায় ‘তার’ করলেন। কারণ স্বপ্নটা দেখে মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আবার, এদিকে মান্দ্রাজের বন্ধুগণ তখন আমার আমেরিকায় যাবার যোগাড় করে তাড়া লাগাচ্ছিল; কিন্তু মায়ের শারীরিক কুশল সংবাদটা না পেয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। আমার ভাব বুঝে মন্মথবাবু বললেন যে, শহরের কিছু দূরে একজন পিশাচসিদ্ধ লোক বাস করে, সে জীবনের শুভাশুভ ভূত-ভবিষ্যৎ সব খবর বলে দিতে পারে। মন্মথবাবুর অনুরোধেও নিজের মানসিক উদ্বেগ দূর করতে তার নিকট যেতে রাজী হলুম। মন্মথবাবু, আমি, আলাসিঙ্গা ও আর একজন খানিকটা রেলে করে, পরে পায়ে হেঁটে সেখানে তো গেলুম। গিয়ে দেখি শ্মশানের পাশে বিকটাকার, শুঁটকো ভূষ-কালো একটা লোক বসে আছে। তার অনুচরগণ ‘কিড়িং মিড়িং’ করে মান্দ্রাজী ভাষায় বুঝিয়ে দিলে—উনিই পিশাচসিদ্ধ পুরুষ। প্রথমটা সে তো আমাদের আমলেই আনলে না। তারপর যখন আমরা ফেরবার উদ্যোগ করছি, তখন আমাদের দাঁড়াবার জন্য অনুরোধ করলে। সঙ্গী আলাসিঙ্গাই দোভাষীর কাজ করছিল; আমাদের দাঁড়াবার কথা বললে। তারপর একটা পেন্সিল দিয়ে লোকটা খানিকক্ষণ ধরে কি আঁক পাড়তে লাগল। পরে দেখলুম, লোকটা concentration (মন একাগ্র) করে যেন একেবারে স্থির হয়ে পড়ল। তারপর প্রথমে আমার নাম গোত্র চৌদ্দপুরুষের খবর বললে; আর বললে যে, ঠাকুর আমার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ত ফিরছেন! মায়ের মঙ্গল সমাচারও বললে! ধর্মপ্রচার করতে আমাকে যে বহুদূরে অতি শীঘ্র যেতে হবে, তাও বলে দিলে! এইরূপে মায়ের মঙ্গলসংবাদ পেয়ে ভট্টাচার্যের সঙ্গে শহরে ফিরে এলুম। এসে কলিকাতার তারেও মায়ের মঙ্গল সংবাদ পেলুম।
যোগানন্দ স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া স্বামীজী বলিলেনঃ
ব্যাটা কিন্তু যা যা বলেছিল, ঠিক তাই তাই হয়ে গেল; তা সেটা ‘কাকতালীয়ে’র ন্যায়ই হোক, বা যাই হোক। যোগানন্দ॥ তুমি পূর্বে এ-সব কিছু বিশ্বাস করতে না, তাই তোমার ঐ-সকল দেখবার প্রয়োজন হয়েছিল!
স্বামীজী॥ আমি কি না দেখে, না শুনে যা তা কতকগুলো বিশ্বাস করি? এমন ছেলেই নই। মহামায়ার রাজ্যে এসে জগৎ-ভেল্কির সঙ্গে সঙ্গে কত কি ভেল্কিই না দেখলুম। মায়া-মায়া!! রাম রাম! আজ কি ছাইভস্ম কথাই সব হল। ভূত ভাবতে ভাবতে লোকে ভূত হয়ে যায়। আর যে দিনরাত জানতে-অজান্তে বলে, ‘আমি নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত আত্মা’, সেই ব্রহ্মজ্ঞ হয়।
এই বলিয়া স্বামীজী স্নেহভরে শিষ্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ
এই-সব ছাইভস্ম কথাগুলোকে মনে কিছুমাত্র স্থান দিবিনি। কেবল সদসৎ বিচার করবি—আত্মাকে প্রত্যক্ষ করতে প্রাণপণ যত্ন করবি। আত্মজ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই। আর সবই মায়া-ভেল্কিবাজি! এক প্রত্যগাত্মাই অবিতথ সত্য—এ কথাটা বুঝেছি; সে জন্যই তোদের বোঝাবার চেষ্টা করছি। ‘একমেবাদ্বয়ং ব্রহ্ম নেহ নানাস্তি কিঞ্চন।’
কথা বলিতে বলিতে রাত্রি ১১টা বাজিয়া গেল। অনন্তর স্বামীজী আহারান্তে বিশ্রাম করিতে গেলেন। শিষ্য স্বামীজীর পাদপদ্মে প্রণত হইয়া বিদায় গ্রহণ করিল। স্বামীজী বলিলেন, ‘কাল আসবি তো?’
শিষ্য॥ আজ্ঞে আসিব বৈকি? আপনাকে দিনান্তে না দেখিলে প্রাণ ব্যাকুল হইয়া ছটফট করিতে থাকে।
স্বামীজী॥ তবে এখন আয়, রাত্রি হয়েছে।
১৫
স্থান—বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী
কাল—নভেম্বর, ১৮৯৮
হইল স্বামীজী কাশ্মীর হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। শরীর তেমন ভাল নাই। শিষ্য মঠে আসিতেই স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলিলেন, ‘কাশ্মীর থেকে ফিরে আসা অবধি স্বামীজী কারও সঙ্গে কোন কথাবার্তা কন না, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। তুই স্বামীজীর কাছে গল্পসল্প করে স্বামীজীর মনটা নীচে আনতে চেষ্টা করিস।’
শিষ্য উপরে স্বামীজীর ঘরে গিয়া দেখিল, স্বামীজী মুক্ত-পদ্মাসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়া আছেন, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন, মুখে হাসি নাই, প্রদীপ্ত নয়নে বহির্মুখী দৃষ্টি নাই, যেন ভিতরে কিছু দেখিতেছেন। শিষ্যকে দেখিবামাত্র বলিলেন, ‘এসেছিস বাবা, বস্’—এই পর্যন্ত। স্বামীজীর বামনেত্রের ভিতরটা রক্তবর্ণ দেখিয়া শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার চোখের ভিতরটা লাল হইয়াছে কেন?’ ‘ও কিছু না’ বলিয়া স্বামীজী পুনরায় স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরেও যখন স্বামীজী কোন কথা কহিলেন না, তখন শিষ্য অধীর হইয়া স্বামীজীর পাদপদ্ম স্পর্শ করিয়া বলিল, ‘৺অমরনাথে যাহা যাহা প্রত্যক্ষ করিলেন, তাহা আমাকে বলিবেন না?’ পাদস্পর্শে স্বামীজীর যেন একটু চমক ভাঙিল, যেন একটু বহির্দৃষ্টি আসিল; বলিলেন, ‘অমরনাথ-দর্শনের পর থেকে আমার মাথায় চব্বিশ ঘণ্টা যেন শিব বসে আছেন, কিছুতেই নাবছেন না।’ শিষ্য শুনিয়া অবাক হইয়া রহিল।