শিষ্য॥ তারপর এ বিষয়ে কিছু ভেবেছিলেন কি?
স্বামীজী॥ ভেবেছিলাম, কিন্তু ভেবে চিন্তে কিছু কূল-কিনারা পাইনি। এখন বোধ হয়, ভগবান্ বুদ্ধদেবকে দেখেছিলুম।
কিছুক্ষণ পরে স্বামীজী বলিলেনঃ মন শুদ্ধ হলে, কামকাঞ্চনে বীতস্পৃহ হলে কত vision (দিব্যদর্শন) দেখা যায়—অদ্ভুত অদ্ভুত! তবে ওতে খেয়াল রাখতে নেই। ঐ-সকলে দিনরাত মন থাকলে সাধক আর অগ্রসর হতে পারে না। শুনিসনি, ঠাকুর বলতেন—‘কত মণি পড়ে আছে (আমার) চিন্তামণির নাচদুয়ারে!’ আত্মাকে সাক্ষাৎ করতে হবে— ও-সব খেয়ালে মন দিয়ে কি হবে?
কথাগুলি বলিয়াই স্বামীজী তন্ময় হইয়া কোন বিষয় ভাবিতে ভাবিতে কিছুক্ষণ মৌনভাবে রহিলেন। পরে আবার বলিতে লাগিলেনঃ
দেখ্, আমেরিকায় অবস্থানকালে আমার কতকগুলি অদ্ভুত শক্তির স্ফুরণ হয়েছিল। লোকের চোখের ভেতর দেখে তার মনের ভেতরটা সব বুঝতে পারতুম মুহূর্তের মধ্যে। কে কি ভাবছে না ভাবছে ‘করামলকবৎ’ প্রত্যক্ষ হয়ে যেত। কারুকে কারুকে বলে দিতুম। যাদের যাদের বলতুম, তাদের মধ্যে অনেকে আমার চেলা হয়ে যেত; আর যারা কোনরূপ মতলব পাকিয়ে আমার সঙ্গে মিশতে আসত, তারা ঐ শক্তির পরিচয় পেয়ে আর আমার দিকেও মাড়াত না।
যখন চিকাগো প্রভৃতি শহরে বক্তৃতা শুরু করলুম, তখন সপ্তাহে ১২।১৪টা, কখনও আরও বেশী লেকচার দিতে হত; অত্যধিক শারীরিক ও মানসিক শ্রমে মহা ক্লান্ত হয়ে পড়লুম। যেন বক্তৃতার বিষয় সব ফুরিয়ে যেতে লাগল। ভাবতুম—কি করি, কাল আবার কোথা থেকে কি নূতন কথা বলব? নূতন ভাব আর যেন জুটত না। একদিন বক্তৃতার পরে শুয়ে শুয়ে ভাবছি, তাইতো এখন কি উপায় করা যায়? ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রার মত এল। সেই অবস্থায় শুনতে পেলুম, কে যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছে; কত নূতন ভাব, নূতন কথা—সে-সব যেন ইহজন্মে শুনিনি, ভাবিওনি! ঘুম থেকে উঠে সেগুলি স্মরণ করে রাখলুম, আর বক্তৃতায় তাই বললুম। এমন যে কতদিন ঘটেছে তার সংখ্যা নেই। শুয়ে শুয়ে এমন বক্তৃতা কতদিন শুনেছি! কখনও বা এত জোরে জোরে তা হত যে, অন্য ঘরের লোক আওয়াজ পেত ও পরদিন আমায় বলত—‘স্বামীজী, কাল অত রাত্রে আপনি কার সঙ্গে এত জোরে কথা কইছিলেন?’ আমি তাদের সে-কথা কোনরূপে কাটিয়ে দিতুম। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড!
শিষ্য স্বামীজীর কথা শুনিয়া নির্বাক হইয়া ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘মহাশয়, তবে বোধ হয় আপনিই সূক্ষ্মদেহে ঐরূপে বক্তৃতা করিতেন এবং স্থূলদেহে কখনও কখনও তার প্রতিধ্বনি বাহির হইত।’
শুনিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘তা হবে।’
অনন্তর আমেরিকার কথা উঠিল। স্বামীজী বলিলেন, ‘সে দেশের পুরুষের চেয়ে মেয়েরা অধিক শিক্ষিত। বিজ্ঞান-দর্শনে তারা সব মহা পণ্ডিত; তাই তারা আমায় অত খাতির করত। পুরুষগুলো দিনরাত খাটছে, বিশ্রামের সময় নেই; মেয়েরা স্কুলে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করে মহা বিদুষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় যে দিকে চাইবি, কেবলই মেয়েদের
শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, গোঁড়া ক্রিশ্চানেরা সেখানে আপনার বিপক্ষ হয় নাই?
স্বামীজী॥ হয়েছিল বৈকি। লোকে যখন আমায় খাতির করতে লাগল, তখন পাদ্রীরা আমার পেছনে খুব লাগল। আমার নামে কত কুৎসা কাগজে লিখে রটনা করেছিল! কত লোক আমায় তার প্রতিবাদ করতে বলত। আমি কিন্তু কিছু গ্রাহ্য করতুম না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—চালাকি দ্বারা জগতে কোন মহৎ কার্য হয় না; তাই ঐ-সকল অশ্লীল কুৎসায় কর্ণপাত না করে ধীরে ধীরে আপনার কাজ করে যেতুম। দেখতেও পেতুম, অনেক সময়ে যারা আমায় অযথা গালমন্দ করত, তারাও অনুতপ্ত হয়ে আমার শরণ নিত এবং নিজেরাই কাগজে contradict (প্রতিবাদ) করে ক্ষমা চাইত। কখনও কখনও এমনও হয়েছে—আমায় কোন বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করেছে দেখে কেহ আমার নামে ঐ-সকল মিথ্যা কুৎসা বাড়ীওয়ালাকে শুনিয়ে দিয়েছে। তাই শুনে সে দোর বন্ধ করে কোথায় চলে গেছে। আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখি—সব ভোঁ ভাঁ, কেউ নেই। আবার কিছুদিন পরে তারাই সত্য কথা জানতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে আমার চেলা হতে এসেছে। কি জানিস বাবা, সংসার সবই দুনিয়াদারি! ঠিক সৎসাহসী ও জ্ঞানী কি এ-সব দুনিয়াদারিতে ভোলে রে বাপ! জগৎ যা ইচ্ছে বলুক, আমার কর্তব্য কার্য করে চলে যাব—এই জানবি বীরের কাজ। নতুবা এ কি বলছে, ও কি লিখছে, ও-সব নিয়ে দিনরাত থাকলে জগতে কোন মহৎ কাজ করা যায় না। এই শ্লোকটা জানিস না?—
নিন্দন্তু নীতিনিপুণা যদি বা স্তুবন্তু
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্।
অদ্যৈব মরণমস্তু শতাব্দান্তরে বা
ন্যায্যাৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ॥৩৫
লোকে তোর স্তুতিই করুক বা নিন্দাই করুক, তোর প্রতি লক্ষ্মীর কৃপা হোক বা না হোক, আজ বা শতবর্ষ পরে তোর দেহপাত হোক, ন্যায়পথ থেকে যেন ভ্রষ্ট হসনি। কত ঝড় তুফান এড়িয়ে গেলে তবে শান্তির রাজ্যে পৌঁছান যায়। যে যত বড় হয়েছে, তার উপর তত কঠিন পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার কষ্টিপাথরে তার জীবন ঘষে মেজে দেখে তবে তাকে জগৎ বড় বলে স্বীকার করেছে। যার ভীরু কাপুরুষ, তারাই সমুদ্রের তরঙ্গ দেখে তীরে নৌকা ডোবায়। মহাবীর কি কিছুতে দৃকপাত করে রে? যা হবার হোক গে, আমার ইষ্টলাভ আগে করবই করব—এই হচ্ছে পুরুষকার। এ পুরুষকার না থাকলে শত দৈবও তোর জড়ত্ব দূর করতে পারে না।
শিষ্য॥ তবে দৈবে নির্ভরতা কি দুর্বলতার চিহ্ন?