প্র॥ আপনার মতে—প্রত্যেক জীবাত্মা কি নিত্য সত্য?
উ॥ জীবসত্তা কতকগুলি সংস্কার বা বুদ্ধির সমষ্টিস্বরূপ, আর এই বুদ্ধিসমূহের প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তন হইতেছে। সুতরাং উহা কখনও অনন্তকালের জন্য সত্য হইতে পারে না। এই মায়িক জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যেই উহার সত্যতা। জীবাত্মা চিন্তা ও স্মৃতির সমষ্টি—উহা কিরূপে নিত্য সত্য হইতে পারে?
প্র॥ বৌদ্ধধর্ম ভারতে লোপ পাইল কেন?
উ॥ বৌদ্ধধর্ম ভারতে প্রকৃতপক্ষে লোপ পায় নাই। উহা কেবল একটি বিপুল সামাজিক আন্দোলন মাত্র ছিল। বুদ্ধের পূর্বে যজ্ঞার্থে এবং অন্যান্য কারণেও অনেক জীবহত্যা হইত, আর লোকে প্রচুর মদ্যপান ও মাংস ভোজন করিত। বুদ্ধের উপদেশের ফলে মদ্যপান ও জীবহত্যা ভারত হইতে প্রায় লোপ পাইয়াছে।
৪
[আমেরিকার হার্ডফোর্ডে ‘আত্মা ঈশ্বর ও ধর্ম’ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতার শেষে শ্রোতৃবৃন্দ কয়েকটি প্রশ্ন করেন, সেই প্রশ্নগুলি ও তাহাদের উত্তর নিম্নে প্রদত্ত হইল।]
শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি বলিলেন—যদি খ্রীষ্টীয় ধর্মোপদেষ্টাগণ লোককে নরকাগ্নির ভয় না দেখান, তবে লোকে আর তাঁহাদের কথা মানিবে না।
উ॥ তাই যদি হয় তো না মানাই ভাল। যাহাকে ভয় দেখাইয়া ধর্মকর্ম করাইতে হয়, বাস্তবিক তাহার কোন ধর্মই হয় না। লোককে তাহার আসুরী প্রকৃতির কথা না বলিয়া তাহার ভিতরে যে দেবভাব অন্তর্নিহিত রহিয়াছে, তাহার বিষয় উপদেশ দেওয়াই ভাল।
প্র॥ ‘স্বর্গরাজ্য এ জগতের নহে’—এ কথা সেই প্রভু (যীশুখ্রীষ্ট) কি অর্থে বলিয়াছিলেন?
উ॥ তাঁহার বলিবার উদ্দেশ্য ছিল যে, স্বর্গরাজ্য আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে। য়াহুদীদের ধারণা ছিল যে, এই পৃথিবীতেই স্বর্গরাজ্য বলিয়া একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। যীশুর সে ভাব ছিল না।
প্র॥ আপনি কি বিশ্বাস করেন, আমরা পূর্বে পশু ছিলাম, এখন মানব হইয়াছি? উ॥ আমার বিশ্বাসক্রমবিকাশের নিয়মানুসারে উচ্চতর প্রাণিসমূহ নিম্নতর জীবসমূহ হইতে আসিয়াছে।
প্র॥ আপনি কি এমন কাহাকেও জানেন, যাঁহার পূর্বজন্মের কথা মনে আছে?
উ॥ আমার এমন কয়েক ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, যাঁহারা আমাকে বলিয়াছেন, তাঁহাদের পূর্বজন্মের কথা স্মরণ আছে। তাঁহারা এমন এক অবস্থা লাভ করিয়াছেন, যাহাতে তাঁহাদের পূর্বজন্মের স্মৃতি উদিত হইয়াছে।
প্র॥ আপনি খ্রীষ্টের ক্রুশে বিদ্ধ হওয়া ব্যাপার কি বিশ্বাস করেন? উ॥ খ্রীষ্ট ঈশ্বরাবতার ছিলেন—লোকে তাঁহাকে হত্যা করিতে পারে নাই। তাহারা যাহা ক্রুশে বিদ্ধ করিয়াছিল, তাহা একটা ছায়ামাত্র, মরীচিকারূপ একটা ভ্রান্তিমাত্র।
প্র॥ যদি তিনি ঐরূপ একটা ছায়াশরীর নির্মাণ করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাহাই কি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অলৌকিক ব্যাপার নহে?
উ॥ আমি অলৌকিক ঘটনাসমূহকে সত্যলাভের পথে সর্বাপেক্ষা অধিক বিঘ্ন বলিয়া মনে করি। বুদ্ধের শিষ্যগণ একবার তাঁহাকে তথাকথিত অলৌকিক ক্রিয়াকারী এক ব্যক্তির কথা বলিয়াছিল। ঐ ব্যক্তি স্পর্শ না করিয়া খুব উচ্চস্থান হইতে একটি পাত্র লইয়া আসিয়াছিল। কিন্তু বুদ্ধদেবকে সেই পাত্রটি দেখাইবামাত্র তিনি তাহা লইয়া পা দিয়া চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন, আর তাহাদিগকে অলৌকিক ক্রিয়ার উপর ধর্মের ভিত্তি নির্মাণ করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, সনাতন তত্ত্বসমূহের মধ্যে সত্যের অন্বেষণ করিতে হইবে। তিনি তাহাদিগকে যথার্থ আভ্যন্তরীণ জ্ঞানালোকের বিষয়, আত্মতত্ত্ব, আত্মজ্যোতির বিষয় শিক্ষা দিয়াছিলেন—আর ঐ আত্মজ্যোতির আলোকে অগ্রসর হওয়াই একমাত্র নিরাপদ পন্থা। অলৌকিক ব্যাপারগুলি ধর্মপথের প্রতিবন্ধক মাত্র। সেগুলিকে সম্মুখ হইতে দূর করিয়া দিতে হইবে।
প্র॥ আপনি কি বিশ্বাস করেন, যীশু শৈলোপদেশ (Sermon on the Mount) দিয়াছিলেন?
উ॥ যীশু শৈলোপদেশ দিয়াছিলেন, ইহা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু এ বিষয়ে অপরাপর লোকে যেমন গ্রন্থের উপর নির্ভর করেন, আমাকেও তাহাই করিতে হয়; আর ইহা জানি যে, কেবল গ্রন্থের প্রমাণের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যাইতে পারে না। তবে ঐ শৈলোপদেশকে আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শকরূপে গ্রহণ করিলে আমাদের কোন বিপদের সম্ভাবনা নাই। আধ্যাত্মিক কল্যাণপ্রদ বলিয়া আমাদের প্রাণে যাহা লাগিবে, তাহাই আমাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে। বুদ্ধ খ্রীষ্টের পাঁচ শত বৎসর পূর্বে উপদেশ দিয়া গিয়াছেন। তাঁহার কথাগুলি প্রেম ও আশীর্বাদে পূর্ণ। কখনও তাঁহার মুখ হইতে কাহারও প্রতি একটি অভিশাপ-বাণী উচ্চারিত হয় নাই। তাঁহার জীবনে কোন অশুভ-অনুধ্যানের কথা শুনা যায় না। জরথুষ্ট্র বা কংফুছের মুখ হইতেও কখনও অভিশাপ-বাণী নির্গত হয় নাই।
৫
[ব্রুকলিন সভার পরিশিষ্ট হইতে সংগৃহীত]
প্র॥ আত্মার পুনর্দেহধারণ-সম্বন্ধীয় হিন্দু মতবাদটি কিরূপ?
উ॥ বৈজ্ঞানিকদের ‘শক্তি বা জড়-সাতত্য’ (Conservation of Energy or Matter) মত যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, ইহাও সেই ভিত্তির উপর স্থাপিত। এই মতবাদ আমাদের দেশের জনৈক দার্শনিকই প্রথম প্রকাশ করেন। এই মতবাদের দার্শনিকরা সৃষ্টি বিশ্বাস করিতেন না। ‘সৃষ্টি’ বলিলে বুঝায়—‘কিছু না’ হইতে ‘কিছু’ হওয়া। ইহা অসম্ভব। যেমন কালের আদি নাই, তেমনি সৃষ্টিরও আদি নাই। ঈশ্বর ও সৃষ্টি যেন দুইটি রেখার মত—উহাদের আদি নাই, অন্ত নাই—উহারা নিত্য পৃথক্। সৃষ্টি সম্বন্ধে আমাদের মত এইঃ উহা ছিল, আছে ও থাকিবে। পাশ্চাত্য-দেশীয়গণকে ভারত হইতে একটি বিষয় শিখিতে হইবে—পরধর্ম-সহিষ্ণুতা। কোন ধর্মই মন্দ নহে, কারণ সকল ধর্মেরই সারভাগ একই প্রকার।