উ॥ তোমরা দুটি বিভিন্ন জিনিষে গোল করে ফেলছ। কর্ম মানে মানবজাতির সেবা বা ধর্মপ্রচারকার্য। প্রকৃত প্রচারে অবশ্য সিদ্ধ পুরুষ ছাড়া আর কারও অধিকার নেই। কিন্তু সেবাতে সকলেরই অধিকার আছে; শুধু তা নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা অপরের সেবা নিচ্ছি, ততক্ষণ আমরা অপরকে সেবা করতে বাধ্য।
২
[ব্রুকলিন নৈতিক সভা, ব্রুকলিন, আমেরিকা]
প্র॥ আপনি বলেন, সবই মঙ্গলের জন্য; কিন্তু দেখিতে পাই, জগতে অমঙ্গল দুঃখ কষ্ট চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে। আপনার ঐ মতের সঙ্গে এই প্রত্যক্ষদৃষ্ট ব্যাপারের সামঞ্জস্য আপনি কিভাবে করিবেন?
উ॥ যদি প্রথমে আপনি অমঙ্গলের অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে পারেন, তবেই আমি ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। কিন্তু বৈদান্তিক ধর্ম অমঙ্গলের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। সুখের সহিত অসংযুক্ত অনন্ত দুঃখ থাকিলে তাহাকে অবশ্য প্রকৃত অমঙ্গল বলিতে পারা যায়। কিন্তু যদি সাময়িক দুঃখকষ্ট হৃদয়ের কোমলতা ও মহত্ত্ব বিধান করিয়া মানুষকে অনন্ত সুখের দিকে অগ্রসর করিয়া দেয়, তবে তাহাকে আর অমঙ্গল বলা চলে না—বরং উহাকেই পরম মঙ্গল বলিতে পারা যায়। আমরা কোন জিনিষকে মন্দ বলিতে পারি না, যতক্ষণ না আমরা অনন্তের রাজ্যে উহার পরিণাম কি দাঁড়ায়, তাহার অনুসন্ধান করি।
ভূত বা পিশাচোপাসনা হিন্দুধর্মের অঙ্গ নহে। মানবজাতি ক্রমোন্নতির পথে চলিয়াছে, কিন্তু সকলেই একরূপ অবস্থায় উপস্থিত হইতে পারে নাই। সেইজন্য দেখা যায়, পার্থিব জীবনে কেহ কেহ অন্যান্য ব্যক্তি অপেক্ষা মহত্তর ও পবিত্রতর। প্রত্যেক ব্যক্তিরই তাহার বর্তমান উন্নতিক্ষেত্রের সীমার মধ্যে নিজেকে উন্নত করিবার সুযোগ বিদ্যমান। আমরা নিজেদের নষ্ট করিতে পারি না, আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তিকে নষ্ট বা দুর্বল করিতে পারি না, কিন্তু উহাকে বিভিন্ন দিকে পরিচালিত করিবার স্বাধীনতা আমাদের আছে।
প্র॥ জাগতিক জড় পদার্থের সত্যতা কি কেবল আমাদের নিজ মনেরই কল্পনা নহে?
উ॥ আমার মতে বাহ্য জগতের অবশ্যই একটা সত্তা আছে—আমাদের মনের চিন্তার বাহিরেও উহার একটা অস্তিত্ব আছে। সমগ্র প্রপঞ্চ চৈতন্যের ক্রমবিকাশরূপ মহান্ বিধানের বশবর্তী হইয়া উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছে। এই চৈতন্যের ক্রমবিকাশ জড়ের ক্রমবিকাশ হইতে পৃথক্, জড়ের ক্রমবিকাশ চৈতন্যের বিকাশপ্রণালীর প্রতীকস্বরূপ, কিন্তু ঐ প্রণালীর ব্যাখ্যা করিতে পারে না। আমরা বর্তমান পার্থিব পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বদ্ধ থাকায় এখনও অখণ্ড ব্যক্তিত্ব লাভ করিতে পারি নাই। যে-অবস্থায় আমাদের অন্তরাত্মার পরমলক্ষণসমূহ প্রকাশার্থে আমরা উপযুক্ত যন্ত্ররূপে পরিণত হই, যতদিন না আমরা সেই উচ্চতর অবস্থা লাভ করি, ততদিন প্রকৃত ব্যক্তিত্ব লাভ করিতে পারিব না।
প্র॥ যীশুখ্রীষ্টের নিকট একটি জন্মান্ধ শিশুকে আনিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিলঃ শিশুটি নিজের কোন পাপবশতঃ অথবা তাহার পিতামাতার পাপের জন্য অন্ধ হইয়া জন্মিয়াছে?—আপনি এই সমস্যার কিরূপ মীমাংসা করেন?
উ॥ এ সমস্যার ভিতর পাপের কথা আনিবার কোন প্রয়োজন তো দেখা যাইতেছে না; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস—শিশুটির এই অন্ধতা তাহার পূর্বজন্ম-কৃত কোন কার্যের ফলস্বরূপ। আমার মতে এইরূপ সমস্যাগুলি কেবল পূর্বজন্ম স্বীকার করিলেই ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে।
প্র॥ আমাদের আত্মা কি মৃত্যুর পর আনন্দের অবস্থা প্রাপ্ত হয়?
উ॥ মৃত্যু কেবল অবস্থার পরিবর্তন মাত্র। দেশ-কাল আত্মার মধ্যেই বর্তমান, আত্মা দেশকালের অন্তর্গত নহেন। এইটুকু জানিলেই যথেষ্ট যে, আমরা ইহলোকে বা পরলোকে যতই আমাদের জীবনকে পবিত্রতর ও মহত্তর করিব, ততই আমরা সেই ভগবানের সমীপবর্তী হইব, যিনি সমুদয় আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য ও অনন্ত আনন্দের কেন্দ্রস্বরূপ।
৩
[টোয়েণ্টিয়েথ্ সেঞ্চুরী ক্লাব, বোষ্টন, আমেরিকা]
প্র॥ বেদান্ত কি মুসলমান ধর্মের উপর কোনরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল?
উ॥ বেদান্তের আধ্যাত্মিক উদারতা মুসলমান ধর্মের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ভারতের মুসলমান ধর্ম অন্যান্য দেশের মুসলমান ধর্ম হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ। কেবল যখন মুসলমানেরা অপর দেশ হইতে আসিয়া তাহাদের ভারতীয় স্বধর্মীদের নিকট বলিতে থাকে যে, তাহারা কেমন করিয়া বিধর্মীদের সহিত মিলিয়া মিশিয়া রহিয়াছে, তখনই অশিক্ষিত গোঁড়া মুসলমানের দল উত্তেজিত হইয়া দাঙ্গাহাঙ্গামা করিয়া থাকে।
প্র॥ বেদান্ত কি জাতিভেদ স্বীকার করেন?
উ॥ জাতিভেদ বৈদান্তিক ধর্মের বিরোধী। জাতিভেদ একটি সামাজিক প্রথা, আর আমাদের বড় বড় আচার্যেরা উহা ভাঙিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বৌদ্ধধর্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সকল সম্প্রদায়ই জাতিভেদের বিরুদ্ধে প্রচার করিয়াছেন, কিন্তু যতই ঐরূপ প্রচার হইয়াছে, ততই জাতিভেদের নিগড় দৃঢ়তর হইয়াছে। জাতিভেদ রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে মাত্র। উহা বংশপরম্পরাগত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়গুলির সমবায় (Trade Guild)। কোনরূপ উপদেশ অপেক্ষা ইওরোপের সহিত বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় জাতিভেদ বেশী ভাঙিয়াছে।
প্র॥ বেদের বিশেষত্ব কি?
উ॥ বেদের একটি বিশেষত্ব এই যে, যত শাস্ত্রগ্রন্থ আছে, তন্মধ্যে একমাত্র বেদই বার বার বলিয়াছেন—বেদকেও অতিক্রম করিতে হইবে। বেদ বলেন, উহা কেবল অজ্ঞ শিশু-মনের জন্য লিখিত। পরিণত অবস্থায় বেদের গণ্ডী ছাড়াইয়া যাইতে হইবে।