প্র॥ রামকৃষ্ণ মিশন ভারতের পুনরুত্থানকার্যে কোন্ অংশ গ্রহণ করবে?
উ॥ এই মঠ থেকে সব চরিত্রবান্ লোক বেরিয়ে সমগ্র জগৎকে আধ্যাত্মিকতার বন্যায় প্লাবিত করবে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বিষয়েও উন্নতি হতে থাকবে। এইরূপে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যজাতির অভ্যুদয় হবে, শূদ্রজাতি আর থাকবে না। তারা এখন যে-সব কাজ করছে, সে-সব যন্ত্রের দ্বারা হবে। ভারতের বর্তমান অভাব—ক্ষত্রিয়শক্তি।
প্র॥ মানুষের জন্মান্তরে কি পশ্বাদি নীচযোনি হওয়া সম্ভব?
উ॥ খুব সম্ভব। পুনর্জন্ম কর্মের উপর নির্ভর করে। যদি লোকে পশুর মত কাজ করে, তবে সে পশুযোনিতে আকৃষ্ট হবে।
প্র॥ মানুষ আবার পশুযোনি প্রাপ্ত হবে কিরূপে, তা বুঝতে পারছি না। ক্রমবিকাশের নিয়মে সে যখন একবার মানবদেহ পেয়েছে, তখন সে আবার কিরূপে পশুযোনিতে জন্মাবে?
উ॥ কেন, পশু থেকে যদি মানুষ হতে পারে, মানুষ থেকে পশু হবে না কেন? একটা সত্তাই তো বাস্তবিক আছে—মূলে তো সবই এক।
প্র॥ কুণ্ডলিনী বলিয়া বাস্তবিক কোন পদার্থ আমাদের স্থূলদেহের মধ্যে আছে কি?
উ॥ শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, যোগীরা যাকে পদ্ম বলেন, বাস্তবিক তা মানবের দেহে নেই। যোগাভ্যাসের দ্বারা ঐগুলির উৎপত্তি হয়ে থাকে।
প্র॥ মূর্তিপূজার দ্বারা কি মুক্তিলাভ হতে পারে?
উ॥ মূর্তিপূজার দ্বারা সাক্ষাৎভাবে মুক্তি হতে পারে না—তবে মূর্তি মুক্তিলাভের গৌণ কারণস্বরূপ, ঐ পথের সহায়ক। মূর্তিপূজার নিন্দা করা উচিত নয়, কারণ অনেকের পক্ষে মূর্তি অদ্বৈতজ্ঞান উপলব্ধির জন্য মনকে প্রস্তুত করে দেয়—ঐ অদ্বৈতজ্ঞান-লাভেই মানব মুক্ত হতে পারে।
প্র॥ আমাদের চরিত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ কি হওয়া উচিত?
উ॥ ত্যাগ।
প্র॥ আপনি বলেন, বৌদ্ধধর্ম তার দায়স্বরূপ ভারতে ঘোর অবনতি আনয়ন করেছিল—এটি কি করে হল?
উ॥ বৌদ্ধেরা প্রত্যেক ভারতবাসীকে সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী করবার চেষ্টা করেছিল। সকলে তো আর তা হতে পারে না। এইভাবে যে-সে ভিক্ষু হওয়াতে তাদের ভেতরে ক্রমশঃ ত্যাগের ভাব কমে আসতে লাগল। আর এক কারণ—ধর্মের নামে তিব্বত ও অন্যান্য দেশের বর্বর আচার-ব্যবহারের অনুকরণ। ঐ-সব জায়গায় ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে তাদের ভেতর ওদের দূষিত সব আচারগুলি ঢুকল। তারা শেষে ভারতে সেগুলি চালিয়ে দিলে।
প্র॥ মায়া কি অনাদি অনন্ত?
উ॥ সমষ্টিভাবে ধরলে অনাদি অনন্ত বটে, ব্যষ্টিভাবে কিন্তু সান্ত।
প্র॥ মায়া কি?
উ॥ বস্তু প্রকৃতপক্ষে একটি মাত্র আছে—তাকে জড় বা চৈতন্য যে নামেই অভিহিত কর না কেন; কিন্তু ওদের মধ্যে একটি ছেড়ে আর একটিকে ভাবা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। এটাই মায়া বা অজ্ঞান।
প্র॥ মুক্তি কি?
উ॥ মুক্তি অর্থে পূর্ণ স্বাধীনতা—ভালমন্দ উভয়ের বন্ধন থেকেই মুক্ত হওয়া। লোহার শিকলও শিকল, সোনার শিকলও শিকল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন—পায়ে একটা কাঁটা ফুটলে সেই কাঁটা তুলতে আর একটা কাঁটার প্রয়োজন হয়। কাঁটা উঠে গেলে দুটো কাঁটাই ফেলে দেওয়া হয়। এইরূপ সৎপ্রবৃত্তির দ্বারা অসৎপ্রবৃত্তগুলিকে দমন করতে হবে, তারপর কিন্তু সৎপ্রবৃত্তিগুলিকে পর্যন্ত জয় করতে হবে।
প্র॥ ভগবৎকৃপা ছাড়া কি মুক্তিলাভ হতে পারে?
উ॥ মুক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের কোন সম্বন্ধ নেই। মুক্তি আমাদের ভেতর আগে থেকেই রয়েছে।
প্র॥ আমাদের মধ্যে যাকে ‘আমি’ বলা যায়, তা যে দেহাদি থেকে উৎপন্ন নয়, তার প্রমাণ কি?
উ॥ অনাত্মার মত ‘আমি’ও দেহমনাদি থেকেই উৎপন্ন। প্রকৃত ‘আমি’র অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
প্র॥ প্রকৃত জ্ঞানী এবং প্রকৃত ভক্তই বা কাকে বলা যায়?
উ॥ প্রকৃত জ্ঞানী তিনিই, যাঁর হৃদয়ে অগাধ প্রেম বিদ্যমান আর যিনি সর্বাবস্থাতে অদ্বৈততত্ত্ব সাক্ষাৎ করেন। আর তিনিই প্রকৃত ভক্ত, যিনি জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে অভেদ ভাবে উপলব্ধি করে অন্তরে প্রকৃত জ্ঞান-সম্পন্ন হয়েছেন এবং সকলেই ভালবাসেন, সকলের জন্য যাঁর প্রাণ কাঁদে। জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে যে একটির পক্ষপাতী এবং অপরটি বিরোধী, সে জ্ঞানও নয়, ভক্তও নয়—চোর, ঠক।
প্র॥ ঈশ্বরের সেবা করবার কি দরকার?
উ॥ যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব একবার স্বীকার কর, তবে তাঁকে সেবা করবার যথেষ্ট কারণ পাবে। সকল শাস্ত্রের মত ভগবৎসেবা অর্থে ‘স্মরণ’। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হও, তবে তোমার জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে স্মরণ করবার হেতু উপস্থিত হবে।
প্র॥ মায়াবাদ কি অদ্বৈতবাদ থেকে কিছু আলাদা?
উ॥ না—একই। মায়াবাদ ব্যতীত অদ্বৈতবাদের কোন ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়।
প্র॥ ঈশ্বর অনন্ত; তিনি মানুষরূপ ধরে এতটুকু হন কি করে?
উ॥ সত্য বটে ঈশ্বর অনন্ত, কিন্তু তোমরা যেভাবে অনন্ত মনে করছ, অনন্ত মানে তা নয়। তোমরা অনন্ত বলতে একটা খুব প্রকাণ্ড জড়সত্তা মনে করে গুলিয়ে ফেলছ। ভগবান্ মানুষরূপ ধরতে পারেন না বলতে তোমরা বুঝছ—একটা খুব প্রকাণ্ড সাকার পদার্থকে এতটুকু করতে পারা যায় না। কিন্তু ঈশ্বর ও-হিসাবে অনন্ত নন—তাঁর অনন্তত্ব চৈতন্যের অনন্তত্ব। সুতরাং তিনি মানবাকারে আপনাকে অভিব্যক্ত করলেও তাঁর স্বরূপের কোন হানি হয় না।
প্র॥ কেহ কেহ বলেন, আগে সিদ্ধ হও, তারপর তোমার কার্যে অধিকার হবে; আবার কেহ কেহ বলেন, গোড়া থেকেই কর্ম করা উচিত। এই দুটি বিভিন্ন মতের সামঞ্জস্য কিরূপে হতে পারে?