স্বামীজী বলিলেন, ‘না কখনই নহে। কিন্তু নারীদিগের সম্বন্ধে আমাদের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার শুধু তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া পর্যন্ত; নারীগণকে এমন যোগ্যতা অর্জন করাইতে হইবে, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেদের ভাবে মীমাংসা করিয়া লইতে পারে। তাহাদের হইয়া অপর কেহ এ কার্য করিতে পারে না, করিবার চেষ্টা করাও উচিত নহে। আর জগতের অন্যান্য দেশের মেয়েদের মত আমাদের মেয়েরাও এ যোগ্যতা-লাভে সমর্থ।’
‘আপনি নারীজাতির অধিকার-বৈষম্যের কারণ বলিয়া বৌদ্ধধর্মের উপরে দোষারোপ করিতেছেন। জিজ্ঞাসা করি, বৌদ্ধধর্ম কিরূপে নারীজাতির অবনতির কারণ হইল?’
স্বামীজী বলিলেন, ‘সেই কারণের উৎপত্তি বৌদ্ধধর্মের অবনতির সময় ঘটিয়াছিল। প্রত্যেক আন্দোলনেই কোন অসাধারণ বিশেষত্ব থাকে বলিয়াই তাহার জয় ও অভ্যুদয় হয়, কিন্তু আবার উহার অবনতির সময়, যাহা লইয়া তাহার গৌরব, তাহাই তাহার দুর্বলতার প্রধান উপাদান হয়। নরশ্রেষ্ঠ ভগবান্ বুদ্ধের সম্প্রদায়গঠন ও পরিচালন-শক্তি অদ্ভুত ছিল, আর ঐ শক্তিতে তিনি জগৎ জয় করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার ধর্ম কেবল সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের উপযোগী ধর্ম। তাহা হইতে এই অশুভ ফল হইল যে, সন্ন্যাসীর ভেক্ পর্যন্ত সম্মানিত হইতে লাগিল। আবার তিনিই সর্বপ্রথম মঠপ্রথা অর্থাৎ এক ধর্মসঙ্ঘে বাস করিবার প্রথা প্রবর্তিত করিলেন। ইহার জন্য তাঁহাকে বাধ্য হইয়া নারীজাতিকে পুরুষ অপেক্ষা নিম্নাধিকার দিতে হইল, যেহেতু বড় বড় মঠাধ্যক্ষাও নির্দিষ্ট মঠাধ্যক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোন গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারিতেন না। ইহাতে উদ্দিষ্ট আশু ফললাভ, অর্থাৎ তাঁহার ধর্মসঙ্ঘের মধ্যে সুশৃঙ্খলা স্থাপিত হইয়াছিল, ইহা আপনি বুঝিতে পারিতেছেন। কেবল সুদূর ভবিষ্যতে ইহার যে ফল হইয়াছিল, তাহারই জন্য অনুশোচনা করিতে হয়।’
‘কিন্তু বেদে তো সন্ন্যাসের বিধি আছে?’
‘অবশ্যই আছে, কিন্তু সে-সময় ঐ বিষয়ে নরনারীর কোন প্রভেদ করা হয় না। যাজ্ঞবল্ক্যকে জনক-রাজার সভায় কিরূপ প্রশ্ন করা হইয়াছিল, তাহা আপনার স্মরণ আছে তো?১০ তাঁহার প্রধান প্রশ্নকর্ত্রী ছিলেন বাক্পটু কুমারী বাচক্নবী। সেকালে এইরূপ মহিলাকে ‘ব্রহ্মবাদিনী’ বলা হইত। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমার এই প্রশ্নদ্বয় দক্ষ ধানুষ্কের হস্তস্থিত দুইটি শাণিত তীরের মতো’; এই স্থলে তাঁহার নারীত্ব সম্বন্ধে কোনরূপ প্রশ্ন তোলা হয় নাই। আমাদের প্রাচীন আরণ্য-শিক্ষাকেন্দ্রে বালকবালিকার যে সমানাধিকার ছিল, তদপেক্ষা অধিকতর সাম্য আর কি হইতে পারে? আমাদের সংস্কৃত নাটকগুলি পড়ুন—শকুন্তলার উপাখ্যান পড়ুন, তারপর দেখুন—টেনিসনের ‘প্রিন্সেস্’ হইতে আমাদের নূতন কিছু শিখিবার আছে কিনা।’
‘স্বামীজী, আপনি বড় অদ্ভুতরূপে আমাদের অতীতের মহিমা-গৌরব সকলের সমক্ষে প্রকাশ করিতে পারেন!’
স্বামীজী শান্তভাবে বলিলেন—‘হাঁ, তাহার কারণ সম্ভবতঃ আমি জগতের দুইটি দিকই দেখিয়াছি। আর আমি জানি, যে-জাতি সীতা-চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে—ঐ চরিত্র যদি কাল্পনিকও হয়, তথাপি স্বীকার করিতে হইবে, নারীজাতির উপর সেই জাতির যেরূপ শ্রদ্ধা, জগতে তাহার তুলনা নাই। পাশ্চাত্য মহিলাদের জন্য আইনের যে-সব বজ্রবাঁধন আছে, আমাদের দেশের লোক সে-সব জানেও না। আমাদের নিশ্চয়ই অনেক দোষ আছে, আমাদের সমাজে অনেক অন্যায়ও আছে, কিন্তু এই-সকল উহাদেরও আছে। আমাদের এটি কখনও বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, সমগ্র জগতে প্রেম কোমলতা ও সাধুতা বাহিরের কার্যে ব্যক্ত করিবার একটা সাধারণ চেষ্টা চলিয়াছে, আর বিভিন্ন জাতীয় প্রথাগুলির দ্বারা যতটা সম্ভব ঐ-ভাব প্রকাশ করা হইয়া থাকে। গার্হস্থ্য ধর্ম সম্বন্ধে আমি এ-কথা অসঙ্কোচে বলিতে পারি যে, অন্যান্য দেশের প্রথাসমূহ অপেক্ষা ভারতীয় প্রথাসমূহের নানাভাবে অধিকতর উপযোগিতা রহিয়াছে।’
‘তবে স্বামীজী, আমাদের মেয়েদের কোনরূপ সমস্যা আদৌ আছে কি—যাহার মীমাংসা প্রয়োজন?’
‘অবশ্যই আছে—অনেক সমস্যা আছে—সমস্যাগুলিও বড় গুরুতর। কিন্তু এমন একটিও সমস্যা নাই, ‘শিক্ষা’—এই মন্ত্রবলে যাহার সমাধান না হইতে পারে। প্রকৃত শিক্ষার ধারণা কিন্তু এখনও আমাদের মধ্যে উদিত হয় নাই।’
‘তাহা হইলে আপনি প্রকৃত শিক্ষার কি সংজ্ঞা দিবেন?’
স্বামীজী ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—‘আমি কখনও কোন-কিছুর সংজ্ঞা নির্দেশ করি না। তথাপি এইভাবে বর্ণনা করা যাইতে পারে যে, শিক্ষা বলিতে কতকগুলি শব্দ শেখা নহে; আমাদের বৃত্তিগুলির—শক্তিসমূহের বিকাশকেই শিক্ষা বলা যাইতে পারে; অথবা বলা যাইতে পারে—শিক্ষা বলিতে ব্যক্তিকে এমন ভাবে গঠিত করা, যাহাতে তাহার ইচ্ছা সদ্বিষয়ে ধাবিত হয় এবং সফল হয়। এইভাবে শিক্ষিতা হইলে ভারতের কল্যাণসাধনে সমর্থ নির্ভীক মহীয়সী নারীর অভ্যুদয় হইবে। তাঁহারা সঙ্ঘমিত্তা, লীলা, অহল্যাবাঈ ও মীরাবাঈ-এর পদাঙ্ক-অনুসরণে সমর্থ হইবেন, তাঁহারা পবিত্র স্বার্থশূন্য বীর হইবেন। ভগবানের পাদপদ্মস্পর্শে যে বীর্য লাভ হয়, তাঁহারা সেই বীর্য লাভ করিবেন, সুতরাং তাঁহারা বীরপ্রসবিনী হইবার যোগ্যা হইবেন।’
‘তাহা হইলে স্বামীজী, শিক্ষার ভিতর ধর্মশিক্ষাও কিছু থাকা উচিত, আপনি মনে করেন?’
স্বামীজী গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘আমি ধর্মকে শিক্ষার ভিতরকার সার জিনিষ বলিয়া মনে করি। এটি কিন্তু মনে রাখিবেন যে, আমি আমার নিজের বা অপর কাহারও ধর্মসম্বন্ধে মতামতকে ‘ধর্ম’ বলিতেছি না। আমার বিবেচনায় অন্যান্য বিষয়ে যেমন, এ বিষয়েও তেমনি শিক্ষয়িত্রী ছাত্রীর ভাব ও ধারণানুযায়ী শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিবেন এবং তাহাকে উন্নত করিবার এমন সহজ পথ দেখাইয়া দিবেন, যাহাতে তাহাকে খুব কম বাধা পাইতে হয়।’