‘বিশ্বাস করিতে হইবে যে, আত্মা অবিনাশী, অনন্ত ও সর্বশক্তিমান্। আমার বিশ্বাস, গুরুর সাক্ষাৎ সংস্পর্শে গুরুগৃহবাসেই প্রকৃত শিক্ষা হইয়া থাকে। গুরুর সাক্ষাৎ সংস্পর্শে না আসিলে কোনরূপ শিক্ষাই হইতে পারে না। আমাদের বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা ধরুন। পঞ্চাশ বৎসর হইল ঐগুলি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, কিন্তু ফল কি দাঁড়াইয়াছে? ঐগুলি একজনও মৌলিকভাবসম্পন্ন মানুষ তৈরী করিতে পারে নাই। এগুলি শুধু পরীক্ষাকেন্দ্ররূপে দণ্ডায়মান। সাধারণের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগের ভাব আমাদের ভিতর এখনও কিছুমাত্র বিকশিত হয় নাই।’
‘মিসেস বেস্যাণ্ট ও থিওজফি সম্বন্ধে আপনার কি মত?’
‘মিসেস বেস্যাণ্ট খুব ভাল লোক। আমি তাঁহার লণ্ডনের লজে৯ বক্তৃতা দিতে আহূত হইয়াছিলাম। সাক্ষাৎভাবে তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। তবে আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞান বড় অল্প। তিনি এদিক ওদিক হইতে একটু আধটু ভাব সংগ্রহ করিয়াছেন মাত্র। সম্পূর্ণভাবে হিন্দুধর্ম আলোচনা করিবার অবসর তাঁহার হয় নাই। তবে তিনি যে একজন অকপট মহিলা, এ-কথা তাঁহার পরম শত্রুও স্বীকার করিবে। ইংলণ্ডে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ বক্তা বলিয়া পরিগণিত। তিনি একজন ‘সন্ন্যাসিনী’। কিন্তু ‘মহাত্মা’ ‘কুথুমি’ প্রভৃতিতে আমি বিশ্বাসী নহি। তিনি থিওজফিক্যাল সোসাইটির সংস্রব ছাড়িয়া দিন এবং নিজের পায়ে দাঁড়াইয়া যাহা সত্য মনে করেন, তাহা প্রচার করুন।’
সমাজ-সংস্কার সম্বন্ধে কথা পাড়িলে স্বামীজী বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে নিজের মত এইভাবে প্রকাশ করিলেন, ‘আমি এখনও এমন কোন জাতি দেখি নাই, যাহার উন্নতি বা শুভাশুভ তাহার বিধবাগণের পতিসংখ্যার উপর নির্ভর করে।’
আমাদের প্রতিনিধি জানিতেন, কয়েক জন ব্যক্তি স্বামীজীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য নীচের তলায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। সুতরাং তিনি যে সংবাদপত্রের তরফ হইতে এইরূপ উৎপীড়ন সহ্য করিতে অনুগ্রহপূর্বক সম্মত হইয়াছিলেন, সেজন্য তাঁহাকে ধন্যবাদ দিয়া আমাদের প্রতিনিধি এইবার বিদায় গ্রহণ করিলেন।
০৮. জাতীয় ভিত্তিতে হিন্দুধর্মের পুনর্বোধন
[‘প্রবুদ্ধ ভারত’, সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮]
সম্প্রতি ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জনৈক প্রতিনিধি কতকগুলি বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের মতামত জানিবার জন্য তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। তিনি সেই আচার্যশ্রেষ্ঠকে জিজ্ঞাসা করেন—‘স্বামীজী, আপনার মতে আপনার ধর্মপ্রচারের বিশেষত্ব কি?’
স্বামীজী প্রশ্ন শুনিবামাত্র উত্তর করিলেন, ‘পরব্যূহভেদ (aggression); অবশ্য এই শব্দ কেবল আধ্যাত্মিক অর্থেই ব্যবহার করিতেছি। অন্যান্য সমাজ ও সম্প্রদায় ভারতের সর্বত্র প্রচার করিয়াছেন, কিন্তু বুদ্ধের পর আমরাই প্রথম ভারতের সীমা লঙ্ঘন করিয়া সমগ্র পৃথিবীতে ধর্মপ্রচারের তরঙ্গ প্রবাহিত করিতে চেষ্টা করিতেছি।’
‘ভারতের পক্ষে আপনার ধর্মান্দোলন কোন্ উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আপনি মনে করেন?’
‘হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি আবিষ্কার করা এবং জাতীয় চেতনা জাগ্রত করিয়া দেওয়া। বর্তমানকালে ‘হিন্দু’ বলিতে ভারতের তিনটি সম্প্রদায় বুঝায়—প্রথম গোঁড়া বা গতানুগতিক সম্প্রদায়; দ্বিতীয় মুসলমান আমলের সংস্কারক-সম্প্রদায়সমূহ এবং তৃতীয় আধুনিক সংস্কারক-সম্প্রদায়সমূহ। আজকাল দেখি, উত্তর হইতে দক্ষিণ পর্যন্ত সকল হিন্দু কেবল একটি বিষয়ে একমত—গোমাংস-ভোজনে সকল হিন্দুরই আপত্তি।’
‘বেদবিশ্বাসে কি সকলেই একমত নহে?’
‘মোটেই না। ঠিক এইটিই আমরা পুনরায় জাগাইতে চাই। ভারত এখনও বুদ্ধের ভাব আত্মসাৎ করিতে পারে নাই। বুদ্ধের বাণী শুনিয়া প্রাচীন ভারত মুগ্ধই হইয়াছিল, নব বলে সঞ্জীবিত হয় নাই।’
‘বর্তমানকালে ভারতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আপনি কি কি বিষয়ে প্রতিভাত দেখিতেছেন?‘
‘বৌদ্ধধর্মের প্রভাব তো সর্বত্রই জাজ্বল্যমান। আপনি দেখিবেন—ভারত কখনও কোন কিছু পাইয়া হারায় না, কেবল উহা আয়ত্ত করিতে—নিজের অঙ্গীভূত করিয়া লইতে সময়ের প্রয়োজন হয়। বুদ্ধ যজ্ঞে প্রাণিবধের মূলে কুঠারাঘাত করিলেন, ভারত সেই ভাব আর ফেলিয়া দিতে পারে নাই। বুদ্ধ বলিলেন, ‘গো-বধ করিও না’; এখন দেখুন আমাদের পক্ষে গো-বধ অসম্ভব ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’
‘স্বামীজী, আপনি পূর্বে যে তিন সম্প্রদায়ের নাম করিলেন, তন্মধ্যে আপনি নিজেকে কোন্ সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করেন?’
স্বামীজী বলিলেন, ‘আমি সকল সম্প্রদায়ের। আমরাই সনাতন হিন্দু।’
এই কথা বলিয়াই তিনি সহসা প্রবল আবেগভরে ও গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘কিন্তু ছুঁৎমার্গের সহিত আমাদের কিছুমাত্র সংস্রব নাই। উহা হিন্দুধর্ম নহে, উহা আমাদের কোন শাস্ত্রে নাই। উহা প্রাচীন আচারের অননুমোদিত একটি কুসংস্কার—আর চিরদিনই উহা জাতীয় অভ্যুদয়ে বাধা সৃষ্টি করিয়াছে।’
‘তাহা হইলে আপনি আসলে চান জাতীয় অভ্যুদয়?’
‘নিশ্চয়। ভারত কেন সমগ্র আর্যজাতির পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে, তাহার কি কোন যুক্তি আপনি নির্দেশ করিতে পারেন? ভারত কি বুদ্ধিবৃত্তিহীন?—কলাকৌশলহীন? উহার শিল্প, উহার গণিত, উহার দর্শনের দিকে দেখিলে আপনি কি উহাকে কোন বিষয়ে হীন বলিতে পারেন? কেবল প্রয়োজন এইটুকু যে, তাহাকে মোহনিদ্রা হইতে—শত শত শতাব্দীব্যাপী দীর্ঘ নিদ্রা হইতে—জাগিতে হইবে এবং পৃথিবীর সমগ্র জাতির মধ্যে তাহাকে তাহার প্রকৃত স্থান গ্রহণ করিতে হইবে।’