১০
স্থান—কলিকাতা, বাগবাজার
কাল—জানুআরী, ১৮৯৮
কয়েক দিন হইল স্বামীজী বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়ীতে অবস্থান করিতেছেন। প্রাতে, দ্বিপ্রহরে বা সন্ধ্যায় তাঁহার কিছুমাত্র বিরাম নাই; কারণ বহু উৎসাহী যুবক, কলেজের বহু ছাত্র—তিনি এখন যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়া থাকে। স্বামীজী সকলকেই সাদরে ধর্ম ও দর্শনের জটিল তত্ত্বগুলি সহজ ভাষায় বুঝাইয়া দেন; স্বামীজীর প্রতিভার নিকট তাহারা সকলেই যেন অভিভূত হইয়া নীরবে অবস্থান করে।
আজ সূর্যগ্রহণ—সর্বগ্রাসী গ্রহণ। জ্যোতির্বিদগণও গ্রহণ দেখিতে নানাস্থানে গিয়াছেন। ধর্মপিপাসু নরনারীগণ গঙ্গাস্নান করিতে বহুদূর হইতে আসিয়া উৎসুক হইয়া গ্রহণবেলা প্রতীক্ষা করিতেছেন। স্বামীজীর কিন্তু গ্রহণসম্বন্ধে বিশেষ কোন উৎসাহ নাই। শিষ্য আজ স্বামীজীকে নিজহস্তে রন্ধন করিয়া খাওয়াইবে—স্বামীজীর আদেশ। মাছ, তরকারি ও রন্ধনের উপযোগী অন্যান্য দ্রব্যাদি লইয়া বেলা ৮টা আন্দাজ সে বলরাম বাবুর বাড়ী উপস্থিত হইয়াছে। তাহাকে দেখিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘তোদের দেশের মত রান্না করতে হবে; আর গ্রহণের পূর্বেই খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়া চাই।’
বলরাম বাবুদের বাড়ীতে মেয়েছেলেরা কেহই এখন কলিকাতায় নাই। সুতরাং বাড়ী একেবারে খালি। শিষ্য বাড়ীর ভিতরে রন্ধনশালায় গিয়া রন্ধন আরম্ভ করিল। শ্রীরামকৃষ্ণগতপ্রাণা যোগীন-মা নিকটে দাঁড়াইয়া শিষ্যকে রন্ধন-সম্বন্ধীয় সকল বিষয় যোগাড় দিতে ও সময়ে সময়ে দেখাইয়া দিয়া সাহায্য করিতে লাগিলেন এবং স্বামীজী মধ্যে মধ্যে ভিতরে আসিয়া রান্না দেখিয়া তাহাকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন; আবার কখনও বা ‘দেখিস মাছের ‘জুল’ যেন ঠিক বাঙালদিশি ধরনে হয়’ বলিয়া রঙ্গ করিতে লাগিলেন।
ভাত, মুগের দাল, কই মাছের ঝোল, মাছের টক ও মাছের সুক্তনি রান্না প্রায় শেষ হইয়াছে, এমন সময় স্বামীজী স্নান করিয়া আসিয়া নিজেই পাতা করিয়া খাইতে বসিলেন। এখনও রান্নার কিছু বাকী আছে বলিলেও শুনিলেন না, আবদেরে ছেলের মত বলিলেন, ‘যা হয়েছে শীগগীর নিয়ে আয়, আমি আর বসতে পাচ্ছিনে, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে।’ শিষ্য কাজেই তাড়াতাড়ি আগে স্বামীজীকে মাছের সুক্তনি ও ভাত দিয়া গেল, স্বামীজীও তৎক্ষণাৎ খাইতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর শিষ্য বাটিতে করিয়া স্বামীজীকে অন্য সকল তরকারি আনিয়া দিবার পর যোগানন্দ প্রেমানন্দ প্রমুখ অন্যান্য সন্ন্যাসী-মহারাজগণকে অন্ন-ব্যঞ্জন পরিবেশন করিতে লাগিল। শিষ্য কোনকালেই রন্ধনে পটু ছিল না; কিন্তু স্বামীজী আজ তাহার রন্ধনের ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কলিকাতার লোক মাছের সুক্তনির নামে খুব ঠাট্টা তামাসা করে, কিন্তু তিনি সেই সুক্তনি খাইয়া খুশী হইয়া বলিলেন, ‘এমন কখনও খাই নাই। কিন্তু মাছের ‘জুল’টা যেমন ঝাল হয়েছে, এমন আর কোনটাই হয় নাই।’ টকের মাছ খাইয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘এটা ঠিক যেন বর্ধমানী ধরনের হয়েছে।’ অনন্তর দধি সন্দেশ গ্রহণ করিয়া স্বামীজী ভোজন শেষ করিলেন এবং আচমনান্তে ঘরের ভিতর খাটের উপর উপবেশন করিলেন। শিষ্য স্বামীজীর সম্মুখের দালানে প্রসাদ পাইতে বসিল। স্বামীজী তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, ‘যে ভাল রাঁধতে পারে না, সে ভাল সাধু হতে পারে না—মন শুদ্ধ না হলে ভাল সুস্বাদু রান্না হয় না।’
কিছুক্ষণ পরে চারিদিকে শাঁক ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল এবং স্ত্রীকণ্ঠের উলুধ্বনি শুনা যাইতে লাগিল। স্বামীজী বলিলেন, ‘ওরে গেরন লেগেছে—আমি ঘুমোই, তুই আমার পা টিপে দে।’ এই বলিয়া একটু তন্দ্রা অনুভব করিতে লাগিলেন। শিষ্যও তাঁহার পদসেবা করিতে করিতে ভাবিল, ‘এই পুণ্যক্ষণে গুরূপদসেবাই আমার গঙ্গাস্নান ও জপ।’ এই ভাবিয়া শিষ্য শান্তমনে স্বামীজীর পদসেবা করিতে লাগিল। গ্রহণে সর্বগ্রাস৩২ হইয়া ক্রমে চারিদিক সন্ধ্যাকালের মত তমসাচ্ছন্ন হইয়া গেল।
গ্রহণ ছাড়িয়া যাইতে যখন ১৫।২০ মিনিট বাকী আছে, তখন স্বামীজী উঠিয়া মুখ হাত ধুইয়া তামাক খাইতে খাইতে শিষ্যকে পরিহাস করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে বলে, গেরনের সময় যে যা করে, সে নাকি তাই কোটিগুণে পায়; তাই ভাবলুম মহামায়া এ শরীরে সুনিদ্রা দেননি, যদি এই সময় একটু ঘুমুতে পারি তো এর পর বেশ ঘুম হবে, কিন্তু তা হল না; জোর ১৫ মিনিট ঘুম হয়েছে।’
অনন্তর সকলে স্বামীজীর নিকট আসিয়া উপবেশন করিলে স্বামীজী শিষ্যকে উপনিষদ্ সম্বন্ধে কিছু বলিতে আদেশ করিলেন। শিষ্য ইতঃপূর্বে কখনও স্বামীজীর সমক্ষে বক্তৃতা করে নাই। তাহার বুক দুরদুর করিতে লাগিল; কিন্তু স্বামীজী ছাড়িবার পাত্র নহেন। সুতরাং শিষ্য উঠিয়া ‘পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূঃ’ মন্ত্রটির ব্যাখ্যা করিতে লাগিল, পরে ‘গুরুভক্তি’ ও ‘ত্যাগে’র মহিমা বর্ণন করিয়া ব্রহ্মজ্ঞানই যে পরম পুরুষার্থ, ইহা মীমাংসা করিয়া বসিয়া পড়িল। স্বামীজী পুনঃ পুনঃ করতালি দ্বারা শিষ্যের উৎসাহ-বর্ধনার্থ বলিতে লাগিলেন, ‘আহা! সুন্দর বলেছে।’
অনন্তর শুদ্ধানন্দ, প্রকাশানন্দ (তখন ব্রহ্মচারী) প্রভৃতি শিষ্যকে স্বামীজী কিছু বলিতে আদেশ করিলেন। শুদ্ধানন্দ ওজস্বিনী ভাষায় ‘ধ্যান’ সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ এক বক্তৃতা করিলেন। অনন্তর প্রকাশানন্দ প্রভৃতিও ঐরূপ করিলে স্বামীজী উঠিয়া বাহিরের বৈঠকখানায় আগমন করিলেন। তখনও সন্ধ্যা হইতে প্রায় এক ঘণ্টা বাকী আছে। সকলে ঐ স্থানে আসিলে স্বামীজী বলিলেন, ‘তোদের কার কি জিজ্ঞাস্য আছে, বল।’