শিষ্য॥ মহাশয়, আমার মনে হয়, কিছু না দেখিলে শুনিলে যথার্থ বিশ্বাস হয় না। শুনিয়াছি, মথুরবাবু ঠাকুরের সম্বন্ধে কত কি দেখিয়াছিলেন! তাই ঠাকুরে তাঁর এত বিশ্বাস হইয়াছিল।
স্বামীজী॥ যার বিশ্বাস হয় না, তার দেখলেও বিশ্বাস হয় না; মনে করে মাথার ভুল, স্বপ্ন ইত্যাদি। দুর্যোধনও বিশ্বরূপ দেখেছিল, অর্জুনও দেখেছিল। অর্জুনের বিশ্বাস হল, দুর্যোধন ভেল্কিবাজী ভাবলে। তিনি না বুঝালে কিছু বলবার বা বুঝবার যো নেই। না দেখে না শুনে কারও ষোল-আনা বিশ্বাস হয়; কেউ বার বৎসর সামনে থেকে নানা বিভূতি দেখেও সন্দেহে ডুবে থাকে। সার কথা হচ্ছে—তাঁর কৃপা; তবে লেগে থাকতে হবে, তবে তাঁর কৃপা হবে।
শিষ্য॥ কৃপার কি কোন নিয়ম আছে, মহাশয়?
স্বামীজী॥ হাঁও বটে, নাও বটে।
শিষ্য॥ কিরূপ?
স্বামীজী॥ যারা কায়মনোবাক্যে সর্বদা পবিত্র, যাদের অনুরাগ প্রবল, যারা সদসৎ বিচারবান্ ও ধ্যানধারণায় রত, তাদের উপরই ভগবানের কৃপা হয়। তবে ভগবান্ প্রকৃতির সকল নিয়মের (natural law) বাইরে, কোন নিয়ম-নীতির বশীভূত নন—ঠাকুর যেমন বলতেন, ‘তাঁর বালকের স্বভাব’; সেজন্য দেখা যায়—কেউ কোটি জন্ম ডেকে ডেকেও তাঁর সাড়া পায় না; আবার যাকে আমরা পাপী তাপী নাস্তিক বলি, তার ভেতরে সহসা চিৎপ্রকাশ হয়ে যায়—তাকে ভগবান্ অযাচিত কৃপা করে বসেন। তার আগের জন্মের সুকৃতি ছিল, এ কথা বলতে পারিস; কিন্তু এ রহস্য বোঝা কঠিন। ঠাকুর কখনও বলতেন, ‘তাঁর প্রতি নির্ভর কর—ঝড়ের এঁটো পাতা হয়ে যা’; আবার কখনও বলতেন, ‘তাঁর কৃপাবাতাস তো বইছেই, তুই পাল তুলে দে না।’
শিষ্য॥ মহাশয়, এ তো মহা কঠিন কথা। কোন যুক্তিই যে এখানে দাঁড়ায় না।
স্বামীজী॥ যুক্তিতর্কের সীমা মায়াধিকৃত জগতে, দেশ-কাল-নিমিত্তের গণ্ডীর মধ্যে। তিনি দেশকালাতীত। তাঁর law (নিয়ম)-ও বটে, আবার তিনি law (নিয়ম)-এর বাইরেও বটে; প্রকৃতির যা কিছু নিয়ম তিনিই করেছেন, হয়েছেন—আবার সে-সকলের বাইরেও রয়েছেন। তিনি যাকে কৃপা করেন, সে সেই মূহূর্তে beyond law (নিয়মের গণ্ডীর বাইরে) চলে যায়। সেজন্য কৃপার কোন condition (বাঁধাধরা নিয়ম) নেই; কৃপাটা হচ্ছে তাঁর খেয়াল। এই জগৎ সৃষ্টিটাই তাঁর খেয়াল—‘লোকবত্তু লীলাকৈবল্যম্।’২৯ যিনি খেয়াল করে এমন জগৎ গড়তে-ভাঙতে পারেন, তিনি কি আর কৃপা করে মহাপাপীকেও মুক্তি দিতে পারেন না? তবে যে কারুকে সাধন-ভজন করিয়ে নেন ও কারুকে করান না, সেটাও তাঁর খেয়াল—তাঁর ইচ্ছা।
শিষ্য॥ মহাশয়, বুঝিতে পারিলাম না।
স্বামীজী॥ বুঝে আর কি হবে? যতটা পারিস তাঁতে মন লাগিয়ে থাক্। তা হলেই এই জগৎভেল্কি আপনি-আপনি ভেঙে যাবে। তবে লেগে থাকতে হবে। কাম-কাঞ্চন থেকে মন সরিয়ে নিতে হবে, সদসৎ বিচার করতে হবে, ‘আমি দেহ নই’—এইরূপ বিদেহ-ভাবে অবস্থান করতে হবে, ‘আমি সর্বগ আত্মা’—এইটি অনুভব করতে হবে। এরূপে লেগে থাকার নামই পুরুষকার। ঐরূপে পুরুষকারের সহায়ে তাঁতে নির্ভর আসবে—সেটাই হল পরমপুরুষার্থ।
স্বামীজী আবার বলিতে লাগিলেনঃ তাঁর কৃপা তোদের প্রতি না থাকলে তোরা এখানে আসবি কেন? ঠাকুর বলতেন, ‘যাদের প্রতি ঈশ্বরের কৃপা হয়েছে, তারা এখানে আসবেই আসবে; যেখানে-সেখানে থাক বা যাই করুক না কেন, এখানকার কথায়, এখানকার ভাবে সে অভিভূত হবেই হবে।’ তোর কথাই ভেবে দেখ না, যিনি কৃপাবলে সিদ্ধ—যিনি প্রভুর কৃপা সম্যক্ বুঝেছেন, সেই নাগ-মহাশয়ের সঙ্গলাভ কি ঈশ্বরের কৃপা ভিন্ন হয়? ‘অনেক- জন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্’৩০ —জন্মজন্মান্তরের সুকৃতি থাকলে তবে অমন মহাপুরুষের দর্শনলাভ হয়। শাস্ত্রে উত্তমা ভক্তির যে-সকল লক্ষণ দেখা যায়, নাগ-মহাশয়ের সেগুলি সব ফুটে বেরিয়েছে। ঐ যে বলে ‘তৃণাদপি সুনীচেন’,৩১ তা একমাত্র নাগ-মহাশয়েই প্রত্যক্ষ করা গেল। তোদের বাঙাল দেশ ধন্য, নাগ-মহাশয়ের পাদস্পর্শে পবিত্র হয়ে গেছে।
বলিতে বলিতে স্বামীজী মহাকবি শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষের বাড়ী বেড়াইয়া আসিতে চলিলেন। সঙ্গে স্বামী যোগানন্দ ও শিষ্য। গিরিশবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া উপবেশন করিয়া স্বামীজী বলিতে লাগিলেনঃ
জি.সি., মনে আজকাল কেবল উঠছে—এটা করি, সেটা করি, তাঁর কথা জগতে ছড়িয়ে দিই, ইত্যাদি। আবার ভাবি—এতে বা ভারতে আর একটা সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়ে পড়ে। তাই অনেক সামলে চলতে হয়। কখনও ভাবি—সম্প্রদায় হোক। আবার ভাবি—না, তিনি কারও ভাব কদাচ নষ্ট করেননি; সমদর্শিতাই তাঁর ভাব। এই ভেবে মনের ভাব অনেক সময় চেপে চলি। তুমি কি বল?
গিরিশবাবু॥ আমি আর কি বলব? তুমি তাঁর হাতের যন্ত্র। যা করাবেন, তাই তোমাকে করতে হবে। আমি অত শত বুঝি না। আমি দেখছি প্রভুর শক্তি তোমায় দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সাদা চোখে দেখছি।
স্বামীজী॥ আমি দেখছি, আমরা নিজের খেয়ালে কাজ করে যাচ্ছি। তবে বিপদে, আপদে, অভাবে, দারিদ্র্যে তিনি দেখা দিয়ে ঠিক পথে চালান, guide (পরিচালনা) করেন—ঐটি দেখতে পেয়েছি। কিন্তু প্রভুর শক্তির কিছুমাত্র ইয়ত্তা করে উঠতে পারলুম না!
গিরিশবাবু॥ তিনি বলেছিলেন, ‘সব বুঝলে এখনি সব ফাঁকা হয়ে পড়বে। কে করবে, কারেই বা করাবে?’
এইরূপ কথাবার্তার পর আমেরিকার প্রসঙ্গ হইতে লাগিল। গিরিশবাবু ইচ্ছা করিয়াই যেন স্বামীজীর মন প্রসঙ্গান্তরে ফিরাইয়া দিলেন। ঐরূপ করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় গিরিশবাবু অন্য সময়ে আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, ‘ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনেছি—ঐরূপ কথা বেশী কইতে কইতে ওর সংসারবৈরাগ্য ও ঈশ্বরোদ্দীপনা হয়ে যদি একবার স্বস্বরূপের দর্শন হয়, সে যে কে—এ-কথা যদি জানতে পারে, তবে আর এক মুহূর্তও তার দেহ থাকবে না।’ তাই দেখিয়াছি, সর্বদা ঠাকুরের কথাবার্তা কহিতে আরম্ভ করিলে স্বামীজীর সন্ন্যাসী গুরুভ্রাতৃগণও প্রসঙ্গান্তরে তাঁহার মনোনিবেশ করাইতেন। সে যাহা হউক, আমেরিকার প্রসঙ্গ করিতে করিতে স্বামীজী তাহাতেই মাতিয়া গেলেন। ওদেশের সমৃদ্ধি, স্ত্রী-পুরুষের গুণাগুণ, ভোগবিলাস ইত্যাদি নানা কথা বর্ণন করিতে লাগিলেন।