চিকাগোতে ক্লাস করার ব্যাপার নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। ফ্রিস্কোতে টাকা পাচ্ছি এবং শীঘ্রই দেশে ফেরার টাকা যোগাড় করে উঠতে পারব।
তুমি ও অন্যান্য ভগিনীরা কেমন আছ? এপ্রিলের প্রথম দিকে কোন সময়ে চিকাগোয় যাব—আশা করি।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৪৭২*
সান ফ্রান্সিস্কো
২৫ মার্চ, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি এবং ক্রমশঃ বল পাচ্ছি। এখানে মাঝে মাঝে মনে হয়, খুব শীঘ্রই যেন মুক্তি পাব। গত দু-বছরের যন্ত্রণারাশি আমাকে প্রভূত শিক্ষা দিয়েছে। ব্যাধি ও দুর্ভাগ্য পরিণামে আমাদের কল্যাণই সাধন করে, যদিও তখনকার জন্য মনে হয়, বুঝি আমরা একেবারে ডুবে গেলাম।
আমি যেন ঐ অসীম নীলাকাশ; মাঝে মাঝে সে আকাশে মেঘ পুঞ্জীভূত হলেও আমি সর্বদা সেই অসীম নীল আকাশই রয়েছি।
আমি এখন সেই শাশ্বত শান্তির আস্বাদের জন্য লালায়িত, যা আমার এবং প্রত্যেক জীবের ভিতরে চিরদিন রয়েছে। এই হাড়মাসের খাঁচা এবং সুখদুঃখের মিথ্যা স্বপ্ন—এগুলি আবার কি? আমার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। ওঁ তৎ সৎ।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৪৭৩*
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
২৮মার্চ, ১৯০০
নিবেদিতা,
আমি তোমার সৌভাগ্যে খুব আনন্দিত হলাম। আমরা যদি লেগে থাকি, তবে অবস্থা ফিরবেই ফিরবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমার যত টাকার দরকার, তা এখানে বা ইংলণ্ডে পাবে।
আমি খুব খাটছি—আর যত বেশী খাটছি, ততই ভাল বোধ করছি। শরীর খুব অসুস্থ হয়ে আমার একটা বিশেষ উপকার হয়েছে, নিশ্চয়। আমি এখন ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি, অনাসক্তি মানে কি; আর আমার আশা—অতি শীঘ্রই আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হব।
আমরা আমাদের সমুদয় শক্তি একদিকে প্রয়োগ করে একটা বিষয়ে আসক্ত হয়ে পড়ি; আর এই ব্যাপারেরই আর যে একটা দিক্ আছে, যেটা সমভাবে কঠিন হলেও সেটির দিকে আমরা খুব কমই মনোযোগ দিয়ে থাকি; সেটি হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে কোন বিষয় থেকে অনাসক্ত হবার—নিজেকে আলগা করে নেবার শক্তি। এই আসক্তি ও অনাসক্তি— দুই-ই যখন পূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে, তখন মানুষ মহৎ ও সুখী হয়।
আমি মিসেস লেগেটের ১০০০ ডলার দানের সংবাদ পেয়ে বড়ই সুখী হলাম। সবুর কর, তাঁর ভিতর দিয়ে যা কাজ হবার, সেইটা এখন প্রকাশ হচ্ছে। তিনি জানুন আর নাই জানুন, রামকৃষ্ণের কাজে তাঁকে এক মহৎ অংশ গ্রহণ করতে হবে।
তুমি অধ্যাপক গেডিসের যে বিবরণ লিখেছ, তা পড়ে খুব আনন্দ পেলাম। জো-ও একজন অলৌকিকদৃষ্টিসম্পন্ন (clairvoyant) লোকের সম্বন্ধে বড় মজার বিবরণ লিখেছে।
সব বিষয় এখন আমাদের অনুকূল হতে শুরু করেছে। আমি যে অর্থ সংগ্রহ করছি, তা যথেষ্ট না হলেও উপস্থিত কাজের পক্ষে মন্দ নয়।
আমার মনে হয়, এ পত্রখানি তুমি চিকাগোয় পাবে। ইতোমধ্যে জো ও মিসেস বুল নিশ্চয়ই যাত্রা করেছেন।১৯ জো-এর চিঠি ও টেলিগ্রামে তাদের আসার দিন সম্বন্ধে এত গরমিল ছিল যে, তা পড়ে বেশ একটু ফাঁপরে পড়েছিলাম।
মিস সুটার-এর বিশেষ বন্ধু সুইস যুবক ম্যাক্স গেসিক-এর কাছ থেকে একখানি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। মিস সুটারও আমায় তাঁর ভালবাসা জানিয়েছেন, আর তাঁরা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি কবে ইংলণ্ডে যাচ্ছি। তাঁরা লিখেছেন, সেখানে অনেকে ঐ বিষয়ে খবর নিচ্ছে।
সব জিনিষকেই ঘুরে আসতে হবে—বৃক্ষরূপে বিকশিত হতে হলে বীজকে কিছুদিন মাটির নীচে পড়ে পচতে হবে। গত দু-বছর চলছিল যেন এইরূপ মাটির নীচে পচা। মৃত্যুর করালগ্রাসে পড়ে আগেও যখনই আমি ছটফট করেছি, তার পরেই জীবনটা যেন প্রবলভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। এইরূপে একবার রামকৃষ্ণের কাছে উপনীত হই, আর একবার ঐরূপ হবার পর যুক্তরাষ্ট্রে আসতে হল। শেষটিই হয়েছে অন্য সবগুলির মধ্যে বৃহৎ ব্যাপার। সে-ভাব এখন চলে গেছে—এখন আমি এমন স্থির শান্ত হয়ে গেছি যে আমার সময়ে সময়ে নিজেরই আশ্চর্য বোধ হয়। আমি এখন সকাল সন্ধে খুব খাটি, যখন যা পাই খাই, রাত্রি বারটায় শুতে যাই, আর কি গভীর নিদ্রা! আগে কখনও আমার এমন ঘুমোবার শক্তি ছিল না। তুমি আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৪৭৪*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
২৮ মার্চ, ১৯০০
আশীর্বাদভাজন মেরী,
তোমাকে জানাচ্ছি আমি খুবই আনন্দে আছি। তার মানে এ নয় যে, একটা কুহেলিকাময় সুখবাদের দিকে আমি চলেছি, তবে দুঃখকে সহ্য করবার শক্তি আমার বেড়ে যাচ্ছে। এ দুনিয়ার সুখদুঃখের পূতিগন্ধময় বাষ্পের ঊর্ধ্বে আমি উঠে যাচ্ছি, এগুলি আমার কাছে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা স্বপ্নের রাজ্য, এখানে আনন্দ উপভোগই বা কি, আর কান্নাই বা কি; সে-সব স্বপ্ন বৈ তো নয়। তাই অচিরেই হোক, বিলম্বেই হোক সেগুলি ভাঙবেই। ওখানে তোমাদের সব কেমন চলছে? হ্যারিয়েট প্যারিসে খুব আনন্দে কাটাচ্ছে। তার সঙ্গে সেখানে নিশ্চয়ই দেখা করব। আমি একখানা ফরাসী অভিধান কণ্ঠস্থ করছি! কিছু টাকাও করছি; সকাল-সন্ধ্যা কঠোর পরিশ্রম চলছে, তা সত্ত্বেও আগের তুলনায় ভাল। সুনিদ্রা, সুপরিপাক ও সম্পূর্ণ অনিয়ম চলেছে।
তোমরা পূর্বাঞ্চলে যাচ্ছ। এপ্রিলের শেষে চিকাগো যাব বলে মনে করছি। যদি না পারি, তবে নিশ্চয়ই তোমাদের চলে যাবার আগেই পূর্বাঞ্চলে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব।