এক্ষণে আমি এ সমস্ত কাজ হতে অবসর নিলাম। দু-এক দিনের মধ্যে আমি সব ছেড়ে দিয়ে একলা একলা চলে যাব; কোথাও চুপ করে বাকী জীবন কাটাব। তোমরা মাপ করতে হয় কর, যা ইচ্ছে হয় কর। মিসেস বুল বেশী টাকা দিয়েছেন। শরতের ওপর তাঁর একান্ত বিশ্বাস। শরতের পরামর্শ নিয়ে সকল মঠের কাজ কর, যা হয় কর। তবে আমি চিরকাল বীরের মত চলে এসেছি—আমার কাজ বিদ্যুতের মত শীঘ্র, আর বজ্রের মত অটল চাই। আমি ঐ রকম মরব। সেইজন্য আমার কাজটি করে দিও—হারা-জিতার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নাই। আমি লড়ায়ে কখনও পেছপাও হইনি; এখন কি … হব? হার-জিত সকল কাজেই আছে; তবে আমার বিশ্বাষ যে কাপুরুষ মরে নিশ্চিত কৃমিকীট হয়ে জন্মায়। যুগ যুগ তপস্যা করলেও কাপুরুষের উদ্ধার নেই—আমায় কি শেষে কৃমি হয়ে জন্মাতে হবে? আমার চোখে এ সংসার খেলামাত্র—চিরকাল তাই থাকবে। এর মান-অপমান দু-টাকা লাভ-লোকসান নিয়ে কি ছমাস ভাবতে হবে? … আমি কাজের মানুষ! খালি পরামর্শ হচ্ছে—ইনি পরামর্শ দিচ্ছেন, উনি দিচ্ছেন; ইনি ভয় দেখাচ্ছেন তো উনি ডর! আমার চোখে এ জীবনটা এমন কিছু মিষ্টি নয় যে, অত ভয়-ডর করে হুঁশিয়ার হয়ে বাঁচতে হবে। টাকা, জীবন, বন্ধু-বান্ধব, মানুষের ভালবাসা, আমি—সব অত সিদ্ধি নিশ্চিত করে যে কাজ করতে চায়, অত ভয় যদি করতে হয়তো গুরুদেব যা বলতেন যে, ‘কাক বড় স্যায়না—’ তার তাই হয়। আর যাই হোক, এ-সব টাকা-কড়ি, মঠ-মড়ি, প্রচার-ফ্রচার কি জন্য? সমস্ত জীবনের এক উদ্দেশ্য—শিক্ষা। তাছাড়া ধন-বাড়ী স্ত্রী-পুরুষ প্রয়োজন কি?
এজন্য টাকা গেল, কি হার হল—আমি অত বুঝতে পারি না বা পারব না। লড়াই করলুম কোমর বেঁধে—এ আমি খুব বুঝি; আর যে বলে, ‘কুছ পরোয়া নেই, ওয়া বাহাদুর, আমি সঙ্গেই আছি’ … তাকে বুঝি, সে বীরকে বুঝি, সে দেবতাকে বুঝি। তেমন নরদেবের পায়ে আমার কোটি কোটি নমস্কার; তারাই জগৎপাবন, তারাই সংসারের উদ্ধারকর্তা! আর যেগুলো খালি ‘বাপ রে এগিও না, ওই ভয়’—ডিস্পেপ্টিকগুলো—প্রায়ই ভয়তরাসে। তবে আমার মায়ের কৃপায় মনের এত জোর যে, ঘোর ডিস্পেপ্সিয়া কখনও আমায় কাপুরুষ করতে পারবে না। কাপুরুষদের আর কি বলব, কিছুই বলবার নাই। কিন্তু যত বীর এ জগতে বড় কাজ করতে নিষ্ফল হয়েছেন, যাঁরা কখনও কোন কাজ থেকে হঠেননি, যে সকল বীর ভয় আর অহঙ্কারবশে হুকুম অগ্রাহ্য করেননি, তাঁরা যেন আমায় চরণে স্থান দেন। আমি শাক্ত মায়ের ছেলে। মিন্মিনে ভিন্ভিনে, ছেঁড়া ন্যাতা তমোগুণ, আর নরককুণ্ড আমার চক্ষে দু-ই এক। মা জগদম্বে, হে গুরুদেব! তুমি চিরকাল বলতে ,‘এ বীর!’—আমায় যেন কাপুরুষ হয়ে না মরতে হয়। এই আমার প্রার্থনা, হে ভাই! … ‘উৎপৎস্বতেঽস্মি মম কোঽপি সনামধর্ম’—এই ঠাকুরের দাসানুদাসের মধ্যে কেউ না কেউ উঠবে আমার মত, যে আমায় বুঝবে।
‘জাগো বীর ঘুচিয়ে স্বপন; শিয়রে শমন, … তাহা না ডরাক তোমা’—যা কখনও করিনি, রণে পৃষ্ঠ দিইনি, আজ কি … তাই হবে? … হারবার ভয়ে লড়াই থেকে হঠে আসব? হার তো অঙ্গের আভরণ; কিন্তু না লড়েই হারব?
‘জাগো বীর ঘুচিয়ে স্বপন; শিয়রে শমন, … তাহা না ডরাক তোমা’—যা কখনও করিনি, রণে পৃষ্ঠ দিইনি, আজ কি … তাই হবে? … হারবার ভয়ে লড়াই থেকে হঠে আসব? হার তো অঙ্গের আভরণ; কিন্তু না লড়েই হারব?
তারা! মা! … একটা তাল ধরবার মানুষ নেই; আবার মনে মনে খুব অহঙ্কার, ‘আমি সব বুঝি’। … আমি এখন চললাম; সব তোমাদের রইল। মা আবার মানুষ দেন—যাদের ছাতিতে সাহস, হাতে বল, চোখে আগুন জ্বলে, যারা জগদম্বার ছেলে—এমন একজনও যদি দেন, তবে কাজ করব, তবে আবার আসব; নইলে জানলুম মায়ের ইচ্ছা এই পর্যন্ত। … আমার এখন ‘ঘড়িকে ঘোড়া ছোটে’ আমি চাই তড়িঘড়ি কাজ, নির্ভীক হৃদয়।
সারদা বেচারীকে অনেক গাল দিয়েছি। কি করব? আমি গাল দিই; কিন্তু আমারও বলবার ঢের আছে। … আমি হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর article (প্রবন্ধ) লিখেছি। সব … ভাল নইলে বৈরাগ্য হইবে কেন? … শেষটা কি মা আর আমায় জড়িয়ে মারবেন? সকলকার কাছে আমার অনেক অপরাধ—যা হয় কর।
আমি তোমাদের সকলকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি—মা যেন মহাশক্তিরূপে তোমাদের মধ্যে আসেন, ‘অভয়প্রতিষ্ঠং’ অভয় যেন তোমাদের করেন। আমি জীবনে এই দেখলাম, যে সদা আত্ম-সাবধান করে, সে পদে পদে বিপদে পড়ে। যে মানের ভয়ে মরে, সে অপমানই পায়। যে সদা লোকসানের ভয় করে, সে সর্বদা খোয়ায়। … তোমাদের সব কল্যাণ হোক। অলমিতি।
বিবেকানন্দ
৩৮০*
মরী
১১ অক্টোবর, ১৮৯৭
প্রিয় জগমোহনলাল,
… আমি জয়পুরে যে তিন জন সন্ন্যাসীকে পাঠাচ্ছি, তাদের দেখাশোনা করবার জন্য—আপনি বোম্বে যাবার পূর্বে—কাউকে বলে যাবেন। তাদের খাবার ও থাকার একটি ভাল জায়গার ব্যবস্থা করবেন। আমি সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবে। তারা সরল মানুষ—পণ্ডিত নয়। তারা আমারই লোক, একজন আমার গুরুভ্রাতা। যদি তারা চায়, তাদের খেতড়িতে নিয়ে যেতে পারেন, আমি শিঘ্রই সেখানে যাব। এখন চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই বছর বেশী বক্তৃতাও করব না। এই সমস্ত হট্টগোলে আমার আর কোন আস্থা নেই, এতে কার্যক্ষেত্রে কোন কল্যাণই সাধিত হয় না। কলিকাতায় আমার প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য আমাকে নীরবে চেষ্টা করতে হবে; আমি তাই অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে চুপচাপ ঘুড়ে বেড়াচ্ছি।