লস্ এঞ্জেলেস্
ডিসেম্বর, ১৮৯৯
হরিভাই,
… তোমার ঠ্যাঙ জোড়া লেগেছে শুনে খুশী আছি এবং বেশ কাজ করছ তাও শুনছি। … আমার শরীর ঠিক চলছে না। মোদ্দা কথা, আমার আতুপুতু করলেই রোগ হয়। রাঁধছি, যা-তা খাচ্ছি, দিনরাত খাটছি, বেশ আছি, খুব ঘুমাচ্ছি!!
আমি আসছি নিউ ইয়র্কে একমাসের ভেতর। সারদার কাগজ১৩ কি উঠে গেছে না কি? ও আর তো পাই না। Awakened (‘প্রবুদ্ধ ভারত’)—ও ঘুমিয়েছে বুঝি? আমায় তো আর পাঠায় না। যাক্, দেশে তো ‘পিলগ্ হইছন্তি’—কে আছে, কে নেই রে রাম!! ওহে, অচু-র এক চিঠি আজ এসে হাজির। সে রাজপুতানায় শিখর রাজার রামগড় শহরে লুকিয়ে ছিল। কে বলেছে যে, বিবেকানন্দ মরে গেছে। তাই এক পত্রে লিখেছে আমায়!! তাকে একখানা জবাব পাঠাচ্ছি।
আমার সকল কুশল। তোমার, তার কুশল দেবে। ইতি
দাস
বিবেকানন্দ
৪৫১*
921, West 21st Street, লস্ এঞ্জেলেস্
২৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
সত্যি আমি চৌম্বক চিকিৎসা-প্রণালীতে (magnetic healing) ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে উঠছি। মোট কথা, এখন আমি বেশ ভালই আছি। আমার শরীরের কোন যন্ত্র কোনকালেই বিগড়ায়নি—স্নায়বিক দৌর্বল্য ও অজীর্ণতাই আমার দেহে যা-কিছু গোল বাধিয়েছিল।
এখন আমি রোজ খাবারের আগে বা পরে যে-কোন সময়েই হোক মাইলের পর মাইল বেড়িয়ে আসি। আমি বেশ ভাল হয়ে গেছি, আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস—ভালই থাকব।
এখন চাকা ঘুরছে—মা সেই চাকা ঘোরাচ্ছেন। তাঁর কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে, ততদিন তিনি আমায় যেতে দিচ্ছেন না—এটিই হচ্ছে রহস্য।
দেখ, ইংলণ্ড কেমন উন্নতির দিকে এগোচ্ছে! এই রক্তারক্তির পর সেখানকার লোক এই ‘ক্রমাগত লড়াই লড়াই লড়াই’-এর চেয়ে বড় ও উঁচু জিনিষ ভাববার সময় পাবে। এই আমাদের সুযোগ। আমরা এখন একটু উদ্যমশীল হয়ে দলে দলে ওদের ধরব, প্রচুর অর্থসংগ্রহ করব এবং তারপর ভারতীয় কাজটাকেও পুরাদমে চালিয়ে দেব। চারদিকের অবস্থা বেশ আশাপ্রদ বোধ হচ্ছে, অতএব প্রস্তুত হও। চারটি ভগ্নী ও তুমি আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৪৫২*
921, West 21st Street, লস্ এঞ্জেলেস্
২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় ধীরামাতা,
শুভ নববর্ষ আপনার নিকট আসুক এবং বহুবার এভাবে আসতে থাকুক—এই আমার আকাঙ্ক্ষা। আমার স্বাস্থ্য পূর্বাপেক্ষা অনেক ভাল আছে এবং আবার কাজ করবার মত যথেষ্ট শক্তি পেয়েছি। ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি এবং সারদানন্দকে কিছু টাকা (১৩০০ টাকা) পাঠিয়েছি, … দরকার হলে আরও পাঠাব। তিন সপ্তাহ যাবৎ সারদানন্দের কোন সংবাদ পাইনি; আর আজ ভোরে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বেচারা ছেলেরা! আমি মাঝে মাঝে তাদের প্রতি কত রূঢ় ব্যবহারই না করি! এ-সব সত্ত্বেও তারা জানে যে, আমি তাদের সকলের চেয়ে বড় বন্ধু। … আমি তিন সপ্তাহ আগে তাদের ‘তার’ করে জানিয়েছি যে, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। আমি যদি আরও অসুস্থ না হয়ে পড়ি, তবে যেটুকু স্বাস্থ্য এখন আছে, তাতেই চলে যাবে। আমার জন্য মোটেই ভাববেন না, আমি উঠে-পড়ে কাজে লেগে গেছি।
গল্পগুলি আর লিখতে পারিনি বলে দুঃখিত। আমি এছাড়া অন্য কিছু কিছু লিখেছি এবং প্রতিদিনই কিছু লিখিবার আশা রাখি। আমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী শান্তিতে আছি এবং বুঝতে পেরেছি যে, এই শান্তি বজায় রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে অপরকে শেখানো। কাজই হচ্ছে আমার একমাত্র সেফ্টি ভালভ্ (অতিরিক্ত গ্যাস বের করে দিয়ে যন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার)। আমার দরকার হচ্ছে শুধু পরিষ্কার মাথাওয়ালা জনকয়েক লোকের, যারা চেপে কাজ করে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার আনুষঙ্গিক সমস্ত ব্যাপারের দেখাশোনা করবে। আমার আশঙ্কা এই যে, ভারতে এমন লোক পেতে অনেক কাল কেটে যাবে; আর যদি তেমন কোন লোক থাকে, তাহলেও পাশ্চাত্য কারুর কাছে তার শিক্ষা নেওয়া উচিত। আবার, আমার পক্ষে কাজ করা তখনই সম্ভব হয়, যখন আমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। নিঃসঙ্গ অবস্থাতেই আমার শক্তি খোলে বেশী। মা-র যেন তাই অভিপ্রায়। জো-এর বিশ্বাস এই যে, মায়ের মনে অনেক সব বড় বড় ব্যাপারের পরিকল্পনা চলছে—তাই যেন হয়! জো ও নিবেদিতা যেন সত্যি সত্যি ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা হয়ে পড়েছে দেখছি! আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, আমি জীবনে যা-কিছু ঘা খেয়েছি, যা-কিছু যন্ত্রণা ভোগ করেছি—সবই একটা সানন্দ আত্মত্যাগে পরিণত হবে, যদি মা আবার ভারতের দিকে মুখ তুলে চান।
মিস গ্রিন্সটিডেল (Miss Greenstidel) আমায় একখানি চমৎকার চিঠি লিখেছেন— তার অধিকাংশই আপনার সম্বন্ধে। তিনি তুরীয়ানন্দের সম্বন্ধেও খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। তুরীয়ানন্দকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আমার বিশ্বাস, সে চমৎকার কাজ করবে। তার সাহস ও স্থৈর্য আছে।
আমি শীঘ্রই ক্যালিফোর্নিয়াতে কাজ করতে যাচ্ছি। ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে যাবার সময় আমি তুরীয়ানন্দকে ডেকে পাঠাব এবং তাকে প্রশান্ত-মহাসাগরের উপকূলে কাজে লাগাব। আমার নিশ্চিত ধারণা এখানে একটা বড় কর্মক্ষেত্র আছে। ‘রাজযোগ’ বইটা এখানে খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। মিস গ্রিন্সটিডেল আপনার বাড়ীতে খুব শান্তি পেয়েছেন এবং বেশ আনন্দে আছেন। এতে আমি বেশ খুশী আছি। দিনে দিনে তাঁর সব বিষয়ে একটু সুরাহা হোক। তাঁর চমৎকার কার্যক্ষমতা ও ব্যবসাবুদ্ধি আছে।