আমি একান্তভাবে চাই যে কাউকেই যেন কখনও দুঃখ পেতে না হয়, কিন্তু (একথা সত্যি যে) একমাত্র দুঃখই জীবনের গভীরে প্রবেশ করবার অন্তর্দৃষ্টি এনে দেয়। তাই নয় কি?
আমাদের বেদনার মুহূর্তে চিরদিনের মত বন্ধ দুয়ার আবার খুলে যায় এবং অন্তরে আলোর বন্যা প্রবেশ করে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ে। কিন্তু হায়! এ জগতে লব্ধ জ্ঞানকে আমরা কাজে লাগাতে পারি না। যে মুহূর্তে মনে হয় কিছু শিখেছি, তখনই রঙ্গমঞ্চ থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে হয়। এরই নাম মায়া!
এই খেলার জগৎ কোথায় থাকত, আর খেলাই বা কেমন করে চলত, যদি এই খেলার মর্ম আমাদের আগে থেকেই জানা থাকত? চোখ বেঁধে আমাদের খেলা। এই খেলায় আমাদের মধ্যে কেউ শয়তানের অভিনয় করছে, কেউ বা বীরের—কিন্তু জেন, এ-সবই নিছক খেলা। এটুকুই একমাত্র সান্ত্বনা। রঙ্গমঞ্চে সিংহ, ব্যাঘ্র, দানব এবং আরও কত জীবই না আছে, কিন্তু সকলেরই মুখে বন্ধনী আঁটা; তারা তীক্ষ্ণ শব্দ করে, কিন্তু কামড়াতে পারে না।—জগৎ আমাদের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। যদি তুমি চাও, শরীর বিদীর্ণ হলেও বা রক্তের ধারা বইলেও অন্তরে গভীর শান্তি অনুভব করতে পার। আর তা পাবার উপায় হল নৈরাশ্য বা সকল আশা বিসর্জন দেওয়া। তুমি কি তা জান? এটি অক্ষমের হতাশার মনোভাব নয়, বিজয়ীর বিজিত বস্তুর প্রতি যে অবহেলা, এ হল তাই—কোন কিছুকে পাবার জন্য সে যেমন লড়াই করে, পাবার পর তেমনি সেটা তার অযোগ্য মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
এই নৈরাশ্য, নির্বাসনা ও লক্ষ্যহীনতার সঙ্গে প্রকৃতির ঐক্য আছে। প্রকৃতিতে কোন সামঞ্জস্য, যুক্তিবিচার বা পারম্পর্য নেই, যেমন বিশৃঙ্খলা আগেও ছিল, এখনও তেমনি আছে।
নিকৃষ্ট মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এই মিল যে তার চিন্তা পার্থিব, শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গেও মিল তার জ্ঞানের পরিপূর্ণতায়। এরা তিনজনই ৯ লক্ষ্যশূন্য, প্রবাহ-তাড়িত, আশাহীন—তিনজনেই সুখী।
তুমি খোশগল্পভরা চিঠি চাও, তায় নয় কি? কিন্তু আমার ঝুলিতে বেশী গল্প নেই। মিঃ স্টার্ডি দুদিন আগে এসেছে। কাল ওয়েলস্-এ তার বাড়ীতে চলে যাবে। দু-এক দিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কের টিকিট করতে হবে।
পুরানো কোন বন্ধুর দেখা এখনও পাইনি, মিস সুটার (Miss Souter) এবং ম্যাক্স গাইসিক (Max Gysic) ছাড়া—এঁরা এখন লণ্ডনে। এঁরা যেমন বরাবর আমার প্রতি সদয় ছিলেন, এখনও তাই।
কোন খবরই তোমাকে দেবার নেই, কারণ আমি নিজেই লণ্ডনের খবর এখনও কিছু জানি না। গারট্রুড অর্চার্ড (Gertrude Orchard) কোথায় জানি না, জানলে তার কাছে চিঠি লিখতাম। মিস কেট ষ্টীলও (Miss Kate Steel) বাইরে, বৃহস্পতিবার কি শনিবার আসছে।
একজন সুশিক্ষিত ফরাসী বন্ধুর কাছ থেকে পারি-তে তাঁর অতিথি হয়ে থাকবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার যাওয়া হল না। অন্য কোন সময় তাঁর সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে আসব।
কয়েকজন পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবার আশা আছে, হলে শুভেচ্ছা জানাব। আমেরিকায় তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হবে। হয় আমি বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ আটোয়া যেয়ে হাজির হব, কিম্বা তুমি আসবে নিউ ইয়র্কে।
বিদায়, ভাগ্য তোমার প্রতি প্রসন্ন হোক।
সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ
৪৩০
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
লণ্ডন
১০ অগষ্ট, ১৮৯৯
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার পত্রে অনেক সংবাদ পাইলাম। আমার শরীর জাহাজে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু ডাঙায় আসিয়া পেটে বায়ু হওয়ায় একটু খারাপ। একজন ডাক্তার বললে, নিরামিষ খাও, আর দাল ছুঁয়ো না। ইনি এখানকার একজন মুরুব্বী ডাক্তার। এঁর মতে ইউরিক এসিড-গোলমালে যত ব্যারাম হয়। মাংস এবং দাল ইউরিক এসিড বানায়; অতএব ’ত্যাজ্যং ব্রহ্মপদং’ ইত্যাদি। যা হোক, আমি তাকে সেলাম করে চলে এলাম। Examine (পরীক্ষা) করে বললে চিনি-ফিনি নেই—আলবুমেন আছে। যাক! নাড়ী খুব জোর, বুকটাও দুর্বল বটে। মন্দ কি, দিনকতক হবিষ্যাশী হওয়া ভাল। এখানে বড় গোলযোগ—বন্ধু-বান্ধব সব গরমির দিনে বাইরে গেছে। তার উপর শরীর তত ভাল নয়—খাওয়া-দাওয়ায়ও গোলমাল। অতএব দু-চার দিনের মধ্যেই আমেরিকায় চললুম। মিসেস বুলের জন্য একটা হিসাব পাঠাইও—কত টাকা জমি কিনতে, কত টাকা বাড়ি, খাইখরচ কত টাকা ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সারদা বলে, কাগজ চলে না। … আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত খুব advertise করে (বিজ্ঞাপন দিয়ে) ছাপাক দিকি—গড় গড় করে subscriber (গ্রাহক) হবে। খালি ভট্চায্যিগিরি তিন ভাগ দিলে কি লোকে পছন্দ করে!
যা হোক কাগজটার উপর খুব নজর রাখবে। মনে জেন যে, আমি গেছি। এই বুঝে স্বাধীনভাবে তোমরা কাজ কর। ‘টাকাকড়ি, বিদ্যাবুদ্ধি সমস্ত দাদার ভরসা’ হইলেই সর্বনাশ আর কি! কাগজটার পর্যন্ত টাকা আমি আনব, আবার লেখাও আমার সব—তোমরা কি করবে? সাহেবেরা১০ কি করছেন? আমার হয়ে গেছে! তোমরা যা করবার কর। একটা পয়সা আনবার কেউ নেই, একটা প্রচার করবার কেউ নেই, একটা বিষয় রক্ষা করবার বুদ্ধি কারু নেই। এক লাইন লিখবার … ক্ষমতা কারুর নাই—সব খামকা মহাপুরুষ! …তোমাদের যখন এই দশা, তখন ছেলেদের হাতে ছমাস ফেলে দাও সমস্ত জিনিষ—কাগজ-পত্র, টাকা-কড়ি, প্রচার ইত্যাদি। তারাও কিছু না পারে তো সব বেচে-কিনে যাদের টাকা তাদের দিয়ে ফকির হও। মঠের খবর তো কিছুই পাই না। শরৎ কি করছে? আমি কাজ চাই। মরবার আগে দেখতে চাই যে, আজীবন কষ্ট করে যা খাড়া করেছি, তা এক-রকম চলছে। তুমি টাকাকড়ির বিষয় কমিটির সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করবে। কমিটির সই করে নেবে প্রত্যেক খরচের জন্য। নইলে তুমিও বদনাম নেবে আর কি! লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায়—এই দস্তুর। প্রতি পদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়। … ঐ-রকম প্রথমে কুঁড়েমি করতে করতেই লোকে জোচ্চোর হয়। মঠে যারা আছে, তাদের নিয়ে একটি কমিটি করবে, আর প্রতি খরচ তারা সই না দিলে হবে না—একদম! … আমি কাজ চাই, vigour (উদ্যম) চাই—যে মরে সে বাঁচে; সন্ন্যাসীর আবার মরা-বাঁচা কি?