কাজের চাপে নিজেকে মেরে ফেলো না যেন। ওতে কোন লাভ নেই; সর্বদা মনে রাখবে, ‘কর্তব্য হচ্ছে যেন মধ্যাহ্ন-সূর্যের মত—তার তীব্র রশ্মি মানুষের জীবনীশক্তি ক্ষয় করে।’ সাধনার দিক্ দিয়ে ওর সাময়িক মূল্য আছে বটে, তার বেশী করতে গেলে ওটা একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। আমরা জগতের কাজে অংশগ্রহণ করি আর নাই করি, জগৎ নিজের ভাবে চলে যাবেই। মোহের ঘোরে আমরা নিজেকে ধ্বংস করে ফেলি মাত্র। এক-জাতীয় ভ্রান্ত ধারণা আছে, যা চরম নিঃস্বার্থতার মুখোস পরে দেখা দেয়; কিন্তু সবরকম অন্যায়ের কাছে যা মাথা নোয়ায়, সে চরমে অপরের অনিষ্টই করে। নিজেদের নিঃস্বার্থপরতা দিয়ে অপরকে স্বার্থপর করে তোলার কোন অধিকার আমাদের নেই। আছে কি?
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৪১০*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
২৮ অগষ্ট, ১৮৯৮
স্নেহের মেরী,
তোমাকে চিঠি লেখার কোন সুযোগ ইতোমধ্যে করে উঠতে পারিনি, আর তোমারও চিঠি পাবার কোন তাগিদ ছিল না; তাই বাজে অজুহাত দেখাব না। শুনলাম মিসেস লেগেটকে লেখা মিস ম্যাকলাউডের চিঠি থেকে তুমি কাশ্মীর ও আমাদের সম্বন্ধে সমস্ত সংবাদ জানতে পারছ, সুতরাং এ সম্বন্ধে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।
কাশ্মীরে হাইন্সহোল্ড (Heinsholdt)-এর ‘মাহাত্মা’-সন্ধান সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে; প্রথমেই প্রতিপন্ন করতে হবে যে, সমগ্র ব্যাপারটা একটি বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে আসছে, প্রচেষ্টা খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ করা হয়েছে। মাদার চার্চ ও ফাদার পোপ কেমন আছেন? তোমরা কেমন আছ? একজন দল থেকে সরে পড়াতে৭ পুরানো খেলা আরও উৎসাহ সহকারে চলছে কি? ফ্লোরেন্সের কোন প্রতিমূর্তির মত যার চেহারা, সে কেমন আছে (নামটা ভুলে গিয়েছি)?
কয়েকদিনের জন্য আমি দূরে চলে গিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলাদের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি। তারপর যাত্রিদলটি যাচ্ছে কোন পাহাড়ের পিছনে এক বনের মধ্যে একটি শান্ত সুন্দর পরিবেশ, যেখানে কুলকুল করে ছোট নদী বয়ে চলেছে। সেখানে তারা দেবদারু গাছের নীচে বুদ্ধের মত আসন করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকবে।
এ-রকম প্রায় মাসখানেক চলবে; তারপর যখন আমাদের সৎকর্মের ফলভোগ শেষ হবে, তখন আবার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতন হবে। তারপর কয়েক মাস কর্মফল সঞ্চয় করব ও দুষ্কর্মের জন্য আবার নরকে যেতে হবে—চীনে, এবং আমাদের কুকর্ম ক্যাণ্টন ও অন্যান্য নগরের দুর্গন্ধের মধ্যে আমাদের নিমজ্জিত করবে। তারপর জাপানের নরকে। তারপর আবার যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্গলোকে।
কত না সুন্দর সুন্দর জিনিষ তোমাকে পাঠাতে আমার ইচ্ছা, কিন্তু হায়! শুল্ক-তালিকার কথা ভাবলে আমার আকাঙ্ক্ষা ‘মেয়েদের যৌবন ও ভিখারীদের স্বপ্নের মত’ মিলিয়ে যায়।
কথাপ্রসঙ্গে বলছি, আমি খুশী যে, দিনদিন আমার চুল পাকছে। তোমার সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতের পূর্বেই আমার মাথাটি পূর্ণ-বিকশিত একটি শ্বেত পদ্মের মত হবে।
আহা! মেরী যদি তুমি কাশ্মীর দেখতে—শুধুই কাশ্মীর! পদ্ম ও হাঁসে ভরা চমৎকার হ্রদগুলি (হাঁস নেই, রাজহংসী আছে—এটুকু কবির স্বাধীনতা) এবং বায়ু সঞ্চালিত সেই পদ্মগুলিতে বড় বড় কালো কালো ভ্রমর বসবার চেষ্টা করছে (আমি বলতে চাই যে পদ্মগুলি মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে—ইতি কবিতা)—এই দৃশ্য যদি তুমি দেখতে, তা হলে মৃত্যু শয্যাতেও তোমার পুরোপুরি জ্ঞান থাকত। যেহেতু এটা ভূস্বর্গ এবং যেহেতু তর্কশাস্ত্র বলে—হাতের একটি পাখী বনের দুটির সমান, অতএব এই (ভূস্বর্গের) ক্ষণিক দর্শনও লাভজনক, কিন্তু অর্থনীতির দিক্ থেকে অপরটি (অর্থাৎ না-দেখাই) শ্রেয়। কোন কষ্ট নেই, পরিশ্রম নেই, কোন খরচপত্র নেই, ছেলেমানুষি ভাবপূর্ণ অতি সহজ জীবন এবং তারপর সেইটুকুই সব।
আমার চিঠিটা তোমার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে … সুতরাং এখানে শেষ করছি (এ হল নিছক আলস্য)। বিদায়।
সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ
আমার স্থায়ী ঠিকানাঃ
মঠ, বেলুড়
হাওড়া জেলা, বাঙলা, ভারতবর্ষ
৪১১
[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্র ও তার পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি যে, নির্বিঘ্নে সিন্ধি-ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও।
মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরী হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্জাবে যাইবার কল্পনা ছিল। এক্ষণে দেশে অতিশয় গ্রীষ্ম বলিয়া ডাক্তার যাইতে নিষেধ করিতেছেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ বোধ হয় করাচি পৌঁছিব। এক্ষণে এক-রকম ভাল আছি। আমার সঙ্গে এবার কেহ নাই। দুজন আমেরিকান লেডি ফ্রেণ্ড মাত্র আছেন। তাঁহাদের সঙ্গ বোধ হয় লাহোরে ছাড়িব। তাঁহারা কলিকাতায় বা রাজপুতানায় আমার অপেক্ষা করিবেন। আমি সম্ভবতঃ কচ্ছভুজ, জুনাগড়, ভাটনগর, লিমডি ও বরোদা হইয়া কলিকাতায় যাইব। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে চীন ও জাপান হইয়া আমেরিকায় যাইব—এই তো বাসনা। পরে শ্রীপ্রভুর হাত। আমার এখনকার সমস্ত খরচ উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাঁহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর—এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে, এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।