‘যাহা চিরকাল আছে (সৎ), তাহা নাই—এরূপ হইতে পারে না; আবার যাহা কখনও নাই (অসৎ), তাহা আছে—এরূপ হইতে পারে না। সুতরাং যাহা এই সমগ্র বিশ্বকে পরিব্যাপ্ত করিযা আছে, তাহা আদি-অন্তহীন ও অবিনাশী বলিয়া জানিবে। এই বিশ্বে এমন কিছুই নাই যাহা অপরিবর্তনীয় আত্মাকে পরিবর্তিত করিতে পারে। এই দেহের আদি ও অন্ত আছে, কিন্তু যিনি দেহের মধ্যে বাস করেন, তিনি অনাদি ও অবিনশ্বর।’৭
ইহা জানিয়া মোহ ত্যাগ কর এবং যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, পশ্চাৎপদ হইও না—ইহাই আদর্শ। ফল যাহাই হোক, কর্ম করিয়া যাও। নক্ষত্রগণ কক্ষচ্যুত হইতে পারে, সমগ্র জগৎ আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারে, তাহাতে কিছু আসে যায় না। মৃত্যু তো শুধু দেহান্তরপ্রাপ্তি মাত্র! যুদ্ধ করিতে হইবে। ভীরুতা ও কাপুরুষতা দ্বারা কিছুই লাভ করা যায় না। পশ্চাদপসরণের দ্বারা কোন বিপদ দূর করা যায় না। দেবতাদের নিকট তোমরা অহরহ আকুল প্রার্থনা করিতেছ, তাহাতে কি তোমাদের দুঃখ দূর হইয়াছে? ভারতের জনসাধারণ কোটি ছয়েক দেবতার কাছে কান্নাকাটি করা সত্ত্বেও কুকুর-বিড়ালের মত দলে দলে মরিতেছে। দেবতারা কোথায়? তাঁহারা তখনই আগাইয়া আসেন, যখন তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পার। দেবতাদের কি প্রয়োজন?
কুসংস্কারের কাছে এই নতিস্বীকার করা, নিজের মনের কাছে নিজেকে বিকাইয়া দেওয়া তোমার শোভা পায় না। হে পার্থ! তুমি অনন্ত, অবিনশ্বর; তোমার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই। অনন্তশক্তিশালী আত্মা তুমি; ক্রীতদাসের মত ব্যবহার তোমায় শোভা পায় না। উঠ, জাগো, দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া যুদ্ধ কর। যদি মৃত্যু হয় হউক। সাহায্য করিবার কেহ নাই। তুমিই তো জগৎ। কে তোমায় সাহায্য করিতে পারে? ‘জীবগণের অস্তিত্ব শরীর উৎপত্তির পূর্বে এবং মৃত্যুর পরে অব্যক্ত থাকে। শুধু মাঝখানের স্থিতিকালটুকু ব্যক্ত। কাজেই তাহাতে শোকের কারণ কিছুই নাই।’৮
‘কেহ এই আত্মাকে আশ্চর্যরূপে দেখেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্যরূপে বর্ণনা করেন, অপর কেহ এই আত্মাকে আশ্চর্যরূপে শ্রবণ করেন, আবার অনেকে শুনিয়াও ইহাকে জানিতে পারেন না।’৯
কিন্তু এই আত্মীয়স্বজনকে বধ করা যে পাপ—এ-কথা বলার তোমার অধিকার নাই; কারণ তুমি ক্ষত্রিয় এবং বর্ণাশ্রম-অনুযায়ী যুদ্ধ করাই তোমার স্বধর্ম। … ‘সুখ-দুঃখ, জয়- পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হও।’১০
এখানে গীতার অন্য একটি বিশেষ মতবাদের সূচনা করা হইতেছে—অনাসক্তির উপদেশ। অর্থাৎ আমরা কার্যে আসক্ত হই বলিয়া আমাদের কর্মফল ভোগ করিতে হয়। … ‘কেবল যোগযুক্ত হইয়া কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করিলে কর্মবন্ধন ছিন্ন হয়।’১১সমস্ত বিপদ তুমি অতিক্রম করিতে পারিবে। ‘এই নিষ্কাম কর্মযোগের অল্পমাত্র অনুষ্ঠান করিয়া মানব জন্মমরণরূপ সংসারের ভীষণ আবর্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করে।’১২
‘হে অর্জুন, কেবলমাত্র নিশ্চয়াত্মিকা একনিষ্ঠ বুদ্ধি সফলকাম হয়। অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের মন সহস্র বিষয়ে নিবিষ্ট হওয়ায় শক্তির অপচয় ঘটে। অবিবেকীরা বেদোক্ত কর্মে অনুরক্ত; স্বর্গাদি ফলের জনক বেদের কর্মকাণ্ডের বাহিরে কিছু আছে, এ-কথা তাঁহারা বিশ্বাস করে না। কারণ তাঁহারা বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের সাহায্যে ভোগসুখ ও স্বর্গলাভ করিতে চান এবং সেজন্য যজ্ঞাদি করেন।’১৩ ‘এই সকল লোক যতক্ষণ না বৈষয়িক ভোগ-সুখের প্রত্যাশা ত্যাগ করেন, ততক্ষণ তাঁহাদের আধ্যাত্মিক জীবনে সাফল্য আসিতে পারে না।’
ইহাও গীতার আর একটি মহান্ উপদেশ। বিষয়ের ভোগসুখ যতক্ষণ না পরিত্যক্ত হয়, ততক্ষণ আধ্যাত্মিক জীবন আরম্ভ হয় না। ইন্দ্রিয়-সম্ভোগে সুখ কোথায়? ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের ভ্রম সৃষ্টি করে মাত্র। মানুষ মৃত্যুর পরে স্বর্গলোকেও একজোড়া চক্ষু ও নাসিকার কামনা করে। অনেকের কল্পনা—এ-জগতে যতগুলি ইন্দ্রিয় আছে, স্বর্গে গিয়া তদপেক্ষা বেশীসংখ্যক ইন্দ্রিয় পাওয়া যাইবে। অনন্তকাল ধরিয়া সিংহাসনে অসীম ভগবানকে—ভগবানের পার্থিব দেহকে তাঁহারা দেখিতে চান। এই সকল লোকের বাসনা—শরীরের জন্য, শরীরের ভোগসুখের জন্য, খাদ্য ও পানীয়ের জন্য। স্বর্গ তাহাদের নিকট পার্থিব জীবনের বিস্তারমাত্র। মানুষ ইহজীবনের অতিরিক্ত কিছু চিন্তা করিতে পারে না। এই শরীরকে কেন্দ্র করিয়া তাহাদের জীবনের সব-কিছু। ‘মুক্তিপ্রদ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি এই শ্রেণীর মানবের নিকট একান্ত দুর্লভ।’১৪
‘বেদ সত্ত্ব, রজঃ ও তম—এই ত্রিগুণাত্মক বিষয়গুলি শিক্ষা দেয়।’ বেদ কেবল প্রকৃতির অন্তর্গত বিষয়গুলি শিক্ষা দেয়। পৃথিবীতে যাহা দেখা যায় না, লোকে তাহা ভাবিতে পারে না। স্বর্গ লইয়া কথা বলিতে গেলে, তাহাদের মনে জাগে—সিংহাসনে একজন রাজা বসিয়া আছেন, আর লোক তাঁহার নিকট ধূপ জ্বালাইতেছে। সবই প্রকৃতি; প্রকৃতির বাহিরে কিছুই নাই। কাজেই বেদ প্রকৃতি ভিন্ন অন্য কিছু শিক্ষা দেয় না। ‘এই প্রকৃতির পারে যাও; অস্তিত্বের এই দ্বৈত-ভাবের পারে যাও; তোমার ব্যক্তিগত চেতনার পারে যাও; কোন কিছুকে গ্রাহ্য করিও না, মঙ্গল বা অমঙ্গলের দিকে তাকাইও না।’১৫
আমরা নিজদিগকে দেহের সহিত অভিন্নভাবে দেখিতেছি। আমরা দেহমাত্র, অথবা দেহটি আমাদের, আমার দেহে চিমটি কাটিলে আমি চীৎকার করি। এ-সকলই অর্থশূন্য, কারণ আমি আত্মস্বরূপ। দেহকে আত্মার সহিত অভিন্নভাবে চিন্তা করার জন্যই এই দুঃখ-শোক কল্পনা, প্রাণী দেবতা দানব, এই বিশ্বজগৎ—প্রত্যেকটি জিনিষ আসিয়া পড়িয়াছে। আমি চৈতন্যস্বরূপ। তুমি চিমটি কাটিলে আমি কেন লাফাইয়া উঠিব? … এই দাসত্ব লক্ষ্য কর। লজ্জা হয় না তোমার? আমরা নাকি ধার্মিক! আমরা নাকি দার্শনিক! আমরা নাকি ঋষি! ভগবান্ মঙ্গল করুন—আমরা কী? জীবন্ত নরক বলিতে যাহা বুঝায়, আমরা তাহাই। পাগল বলিতে যাহা বুঝায়, আমরা তাহাই।