- বইয়ের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা – অষ্টম খণ্ড
- লেখকের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দ
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
০১. পত্রাবলী (পূর্বানুবৃত্তি) (৩৭৫-৫৫২)
০১. পত্রাবলী ৩৭৫-৩৮৪
৩৭৫*
শ্রীনগর, কাশ্মীর
১ অক্টোবর, ১৮৯৭
কল্যাণীয়া মার্গ১,
অনেকে অপরের নেতৃত্বে সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারে। সকলেই কিছু নেতা হয়ে জন্মায় না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নেতা তিনিই, যিনি শিশুর মত অন্যের উপর নেতৃত্ব করেন। শিশুকে আপাততঃ অন্যের উপর নির্ভরশীল বলে মনে হলেও, সে-ই সমগ্র বাড়ীর রাজা। অন্ততঃ আমার ধারণা এই যে, এই হল নেতৃত্বের মূল রহস্য। … অনুভব করে সত্য, কিন্তু জনকয়েকেই মাত্র প্রকাশ করতে পারে। অন্যের প্রতি অন্তরের প্রেম, প্রশংসা ও সহানুভূতি প্রকাশ করার যে ক্ষমতা, তাই একজনকে অপরের অপেক্ষা ভাব প্রচারে অধিক সাফল্য দান করে।
তোমার কাছে কাশ্মীরের বর্ণনা দেবার চেষ্টাও করব না। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, এই ভূস্বর্গ ছাড়া অন্য কোন দেশ ছেড়ে আসতে আমার কখনও মন খারাপ হয়নি। সম্ভব হলে, রাজাকে রাজী করিয়ে এখানে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবারও যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এখানে অনেক কিছু করবার আছে—আর উপকরণও এত আশাপ্রদ!
বড় অসুবিধা এইঃ আমি দেখতে পাই—অনেকে তাদের প্রায় সবটুকু ভালবাসাই আমাকে অর্পণ করে; কিন্তু প্রতিদানে কোন ব্যক্তিকে আমার তো সবটুকু দেওয়া চলে না; কারণ একদিনেই তাহলে সমস্ত কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। নিজের গণ্ডীর বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত নয়—এমন লোকও আছে, যারা এরূপ প্রতিদানই চায়। কর্মের সাফল্যের জন্য যত বেশী সম্ভব লোকের উৎসাহপূর্ণ অনুরাগ আমার একান্ত প্রয়োজন; অথচ আমাকে সম্পূর্ণভাবে গণ্ডীর বাইরে থাকতে হবে। নতুবা হিংসা ও কলহে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। নেতা যিনি, তিনি থাকবেন ব্যক্তির গণ্ডীর বাইরে। আমার বিশ্বাস তুমি একথা বুঝতে পারছ। আমি একথা বলছি না যে, অপরের শ্রদ্ধাকে তিনি পশুর মত নিজের কাজে লাগাবেন, আর মনে মনে হাসবেন। আমি যা বলতে চাই তা আমার নিজের জীবনেই পরিস্ফুট; আমার ভালবাসা একান্তই আমার আপনার জিনিষ, আবার প্রয়োজন হলে—বুদ্ধদেব যেমন বলতেন ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়’—তেমনি আমি নিজ হস্তেই আমার হৃদয় উৎপাটিত করতে পারি। এ প্রেমে উন্মত্ততা আছে, কিন্তু কোন বন্ধন নেই। প্রেমের প্রভাবে অচেতন জড়বস্তু চেতনে পরিবর্তিত হয়। বস্তুতঃ এই হল আমাদের বেদান্তের সার কথা। একই সদ্বস্তু অজ্ঞানীর চক্ষে ‘জড়’ এবং জ্ঞানীর চক্ষে ‘ভগবান্’ বলে প্রতিভাত হন এবং জড়ের মধ্যে যে চেতনের ক্রমিক পরিচয় লাভ—তাই হল সভ্যতার ইতিহাস। অজ্ঞানীরা নিরাকারকেও সাকাররূপে দেখে, জ্ঞানী সাকারেও নিরাকার এর দর্শন পান। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দের মধ্যে আমরা শুধু এই শিক্ষাই পাচ্ছি। … অতিরিক্ত ভাবপ্রবণতা কর্মের পক্ষে অনিষ্টকর। ‘বজ্রের মত দৃঢ় অথচ কুসুমের মত কোমল’—এটিই হচ্ছে সার নীতি।
চিরস্নেহশীল সত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৭৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
কাশ্মীর হইতে গত পরশু সন্ধ্যাকালে মরীতে পৌঁছিয়াছি। সকলেই বেশ আনন্দে ছিল। কেবল কেষ্টলাল ও গুপ্তের মধ্যে মধ্যে জ্বর হইয়াছিল—তাহাও সামান্য। এই Address (অভিনন্দনটি) খেতড়ির রাজার জন্য পাঠাতে হইবে—সোনালি রঙে ছাপাইয়া ইত্যাদি। রাজা ২১।২২ অক্টোবর নাগাদ বোম্বে পৌঁছিবেন। বোম্বেতে আমাদের কেহই এক্ষণে নাই। যদি কেহ থাকে, তাহাকে এক কপি পাঠাইয়া দিবে—যাহাতে সেই ব্যক্তি রাজাকে জাহাজেই ঐ Address প্রদান করে বা বোম্বে শহরেতে কোথাও। উত্তম কপিটি খেতড়িতে পাঠাইবে। একটি মিটিং-এ (সভাতে) ঐটি পাস করিয়া লইবে। যদি কিছু বদলাইতে ইচ্ছা হয়, হানি নাই। তাহার পর সকলেই সহি করিবে; কেবল আমার নামের জায়গাটা খালি রাখিবে—আমি খেতড়ি যাইয়া সহি করিব। এ বিষয়ে কোন ত্রুটি না হয়। যোগেন কেমন আছে পত্রপাঠ লিখিবে—লালা হংসরাজ সাহানি, উকিল, রাওলপিণ্ডির ঠিকানায়। রাজা বিনয়কৃষ্ণের তরফের Address (অভিনন্দন)-টা দুদিন নয় দেরী হবে— আমাদেরটা যেন পৌঁছায়।
এইমাত্র তোমার ৫ তারিখের পত্র পাইলাম। যোগেনের সংবাদে বিশেষ আনন্দিত হইলাম এবং আমার এই চিঠি পাইবার পূর্বেই হরিপ্রসন্ন বোধ হয় আম্বালায় পৌঁছিবে। আমি তাহাদিগকে ঠিক ঠিক advice (নির্দেশ) সেখানে পাঠাইব। মা-ঠাকুরাণীর জন্য ২০০ টাকা পাঠাইলাম—প্রাপ্তিস্বীকার করিবে। … ভবনাথের স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছুই কেন লিখ নাই। তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলে কি?
ক্যাপ্টেন সেভিয়ার বলিতেছেন যে, তিনি জায়গার জন্য অধীর হইয়া পড়িয়াছেন। মসূরীর নিকট বা অন্য কোন central (কেন্দ্রস্থানীয়) জায়গায় একটা স্থান যত শীঘ্র হয়—তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, মঠ হতে দু-তিন জন এসে জায়গা select (পছন্দ) করে। তাদের মনোনীত হলেই তিনি মরী হতে গিয়ে খরিদ করে একদম বিল্ডিং শুরু করবেন। খরচ অবশ্য তিনিই পাঠাবেন। আমার selection (পছন্দ) তো এক আমাদের ইঞ্জিনিয়ার। বাকী আর যে যে এ বিষয়ে বোঝে—পাঠাবে। ভাব এই যে, খুব ঠাণ্ডাস্থানেও কাজ নাই, আবার গরমও হয় না। দেরাদুন গরমিকালে অসহ্য—শীতকালে বেশ। মসূরী itself (খাস মসূরী) শীতকালে বোধহয় সকলের পক্ষে ঠিক নয়। তার আগিয়ে বা পেছিয়ে—অর্থাৎ ব্রিটিশ বা গাড়োয়াল রাজ্যে জায়গা পাওয়া যাবেই। অথচ সেই জায়গার বারমাস জল চাই নাইবার-খাবার জন্য। এ বিষয়ে মিঃ সেভিয়ার তোমার খরচ চেয়ে পাঠিয়ে চিঠি লিখছেন। তাঁর সঙ্গে সমস্ত ঠিকানা করবে।